ঘূর্ণিঝড় রেমালের ধ্বংসযজ্ঞের পরে বাস্তুহারা হাজারো পরিবারকে সহায়তা করে ঘুরে দাঁড়াতে পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের হারিচাঁদ মণ্ডল ও তার স্ত্রী দীপ্তি মণ্ডলের মতো অনেকেই এ সহায়তার মাধ্যমে আশ্রয় ও সম্মানের জীবন ফিরে পেয়েছেন।
হরিণখোলা গ্রামের এই পরিবারটি আগে টিনশেড ঘরে বসবাস করত। ২৫ মে ২০২৪-এ আঘাত হানা রেমালে তাদের ঘর ভেঙে যায় ও ফসল নষ্ট হয়। এরপর তারা খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছিলেন।
রেড ক্রিসেন্টের সহায়তায় তারা পেয়েছেন এক লাখ ১৫ হাজার ৭০০ টাকা, যা দিয়ে ঘর নির্মাণ, টয়লেট ও পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। দীপ্তি মণ্ডল বলেন, “এই সাহায্য না পেলে আমরা হয়তো আজও খোলা আকাশের নিচে থাকতাম।”
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মনোরঞ্জন মল্লিক জানান, রেমালে তার ঝুপড়িঘর ভেঙে গেলে পরিবারে কেউ প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নেন, কেউ থাকেন ছাউনি দিয়ে তৈরি ঘরে। পরে রেড ক্রিসেন্টের দেওয়া ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তারা ঘর পুনর্নির্মাণ করেন।
খুলনা জেলা রেড ক্রিসেন্ট ইউনিট অফিসার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, “দুইটি প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।”
ঘূর্ণিঝড় রেমাল দেশের ১৯টি জেলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১১১ কিলোমিটার বেগে বাতাস ও ৫–৮ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়।
এই দুর্যোগে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি তাদের ‘সাইক্লোন রেমাল অপারেশন’ এর আওতায় ২ লাখ ৮৩ হাজার মানুষকে সহায়তা দিয়েছে। জরুরি সহায়তায় ১১ জেলার ২৮ হাজার ২০৮ পরিবারকে ৬ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
৭ দিনের খাদ্য সহায়তা পেয়েছে ১৬ হাজার ৬০০ পরিবার, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছে ১১ হাজার ৮৯ জন এবং মনোসামাজিক সহায়তা পেয়েছে ১ হাজার ৮৫২ জন।
স্বাস্থ্যবিধি ও পানি সরবরাহের আওতায় ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৫০ লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়। ৮ হাজার ৫০০ জেরিক্যান ও ২ হাজার ৭৫০ পরিবারকে হাইজিন কিট দেওয়া হয়।
ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণে খুলনা ও পিরোজপুর জেলায় ৫৩৫ পরিবারকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হয়। ৬৬৩ পরিবার পেয়েছে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা ও হাইজিন কিট। স্থাপন ও সংস্কার করা হয়েছে ১৫টি টিউবওয়েল এবং ২৫টি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট।
জীবিকা পুনরুদ্ধারে ৫৫০ পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ২৫৩ পরিবারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
স্বাস্থ্য খাতে ২০ হাজার মানুষকে টিকাদান, রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ৫টি মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুনর্নির্মাণ এবং ৮টি কেন্দ্রে সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে।
এছাড়া ৭টি রাস্তা ও একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।
পিরোজপুর জেলার ৯ লাখ মানুষ রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি ইউনিয়নে রেড ক্রিসেন্ট ১ হাজার ১০০ পরিবারকে খাদ্য ও নগদ সহায়তা দেয়।
ক্ষতিগ্রস্ত একজন, সঞ্জিত হালদার জানান, “রেমালে আমার ঘর-ফসল সব শেষ হয়ে যায়। রেড ক্রিসেন্ট পাশে না থাকলে মাথা গোঁজার ঠাঁইও পেতাম না।”
জেলে শাহিদুল শেখ বলেন, “আমার বাড়ি ও গাছপালা সব ভেঙে যায়। পরে রেড ক্রিসেন্টের ৫০ হাজার টাকায় ঘর, ২৫ হাজার টাকায় টয়লেট ও ৩৫ হাজার টাকায় ছোট ব্যবসা শুরু করেছি।”
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক আজিজুল ইসলাম বলেন, “আমাদের জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা ও বাজেট রয়েছে, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায়। জরুরি সময় অনুমোদনের অপেক্ষা না করেই বাজেট ছাড়া যায়।”