প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তিনটি শূন্যের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন বিশ্ব গড়া এখন আর স্বপ্ন নয়, বরং পৃথিবীকে বাঁচাতে এটি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। ব্যক্তিগত মুনাফাবিহীন নতুন ধরনের ব্যবসা অর্থাৎ ‘সামাজিক ব্যবসা’ চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি এই মন্তব্য করেন।
সোমবার রোমে অবস্থিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে বিশ্ব খাদ্য ফোরামের (ডব্লিউএফএফ) ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্ট ২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ‘তিন শূন্যের বিশ্ব’ তৈরি করা: দারিদ্র্য দূর করতে সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, সকলের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বকে শূন্য করা এবং নিট কার্বন নিঃসরণ শূন্যতে নিয়ে আসা। এটি কোনো স্বপ্ন নয়, বরং পৃথিবীকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়।”
অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস ক্ষুধা নিরসনে বৈশ্বিক খাদ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য ছয়টি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোর ব্যর্থতার কারণেই বিশ্বে ক্ষুধা সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের জন্য আরও গভীরে যাওয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অবশ্যই পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। মুনাফা সর্বাধিকীকরণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পুরোনো পদ্ধতি কোটি কোটি মানুষকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।”
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে তিনি বলেন, “আমাদের নতুন ধরনের ব্যবসা যোগ করতে হবে, যা হলো সামাজিক ব্যবসা। এটি ব্যক্তিগত মুনাফাবিহীন একটি ব্যবসায়িক মডেল, যা সমস্যার সমাধান করে, নতুন সমস্যা তৈরি করে না।” তিনি আরও যোগ করেন, বিশ্বজুড়ে অনেক সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং নীতি সহায়তার অভাবে সেগুলো সেভাবে এগোতে পারছে না।
সামাজিক ব্যবসাকেই ভবিষ্যৎ উল্লেখ করে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “আমরা বাংলাদেশে এর শক্তি দেখেছি। গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে কীভাবে দরিদ্র নারীরা শক্তিশালী উদ্যোক্তা হতে পারেন। গ্রামীণ ড্যানোন শিশুদের পুষ্টিহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করছে।” তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বজুড়ে গড়ে ওঠা এ ধরনের সামাজিক ব্যবসাগুলো সাধারণ মানুষ ও সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়িত করেছে। এগুলো কোনো তত্ত্ব নয়, জীবন্ত উদাহরণ।
ড. ইউনূস তরুণ উদ্যোক্তা, নারী, কৃষক এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের সহায়তার জন্য ‘সামাজিক ব্যবসা তহবিল’ গঠনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আমাদের অবশ্যই এই ধরনের উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য আইনি ও আর্থিক কাঠামো তৈরি করতে হবে, তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না।”
‘তিন শূন্যের বিশ্ব’ নির্মাণে তরুণদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আজকের তরুণরা আগের মতো নয়। তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত, সৃজনশীল এবং তাদের হাতে এমন প্রযুক্তি রয়েছে যা ২০ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল।”
আরো পড়ুন: বিশ্ব খাদ্য ফোরামে ছয় দফা প্রস্তাব রাখলেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস
তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আসুন আমরা তাদের চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে না বলি। বরং তাদের চাকরি সৃষ্টির জন্য ক্ষমতায়ন করি। তাদের বলি, তোমরা চাকরিপ্রার্থী নও, তোমরা চাকরি সৃষ্টিকারী।” বিনিয়োগ তহবিল ও সামাজিক ব্যবসা তহবিল তৈরির মাধ্যমে তরুণদের পুঁজির জোগান দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
বৈশ্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের ভূমিকার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে গ্লোবাল অ্যালায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এফএও এবং জি-২০ এর অধীনে আমরা প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
পরিশেষে তিনি বলেন, “আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি তিন শূন্যের বিশ্ব গড়তে একসঙ্গে কাজ করি।” উদ্ভাবন ও কল্পনার ওপর জোর দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “এই ফোরামের মূল ভিত্তি—তারুণ্য, বিজ্ঞান এবং বিনিয়োগ—শুধু স্লোগান নয়। এগুলো আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা ও সমাজকে রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। যদি আমরা কল্পনা করতে পারি, তবে আমরা তা তৈরিও করতে পারব।”