Tuesday, July 22, 2025
Homeজাতীয়“হারিয়ে গেছে আমার বুকের টুকরো” — উত্তরা দুর্ঘটনার পর হাসপাতালগুলোতে কান্নার আহাজারি

“হারিয়ে গেছে আমার বুকের টুকরো” — উত্তরা দুর্ঘটনার পর হাসপাতালগুলোতে কান্নার আহাজারি

শিশুদের সন্ধানে ছুটে চলা আত্মীয়স্বজন, স্বজনহারা পিতা-মাতার বুকফাটা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের বাতাস

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের মর্মান্তিক ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের পরিবেশ হয়ে উঠেছে ভারী, কান্না আর আতঙ্কে ভরে উঠেছে চারপাশ। স্বজন হারানো মানুষগুলো এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রিয়জনের খোঁজে।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের কক্ষ ৫২০–এর সামনে ছোট্ট একটি মেয়ের ছবি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণী, হাবিবা সুলতানা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবাইকে দেখিয়ে বলছিলেন, “সে আমার ভাগ্নি আফিয়া ফেরদৌস, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। কেউ কি দেখেছেন আমার বুকের টুকরোকে? প্লিজ বলুন।” তিনি জানান, “তার বাবা-মা স্কুলে খুঁজছেন, আমি হাসপাতালে।”

একই ইনস্টিটিউটে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়েছেন রুবেল আহমেদ, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভির আহমেদের বাবা। পাশে থাকা তাঁর ভাই শওকত আলী বলেন, “আমরা শুনেছি ছেলেটি মারা গেছে। তখন থেকেই ভাই বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। প্রতিদিনের মতোই হাসিমুখে স্কুলে গিয়েছিল সে। সব শেষ হয়ে গেল এক নিমেষে।”

স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরীকেও পাওয়া গেছে বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে। তাঁর ৯৫ শতাংশ শরীরে আগুনে পোড়া। ভাবি ফারহানা দীপা বলেন, “আমরা কিছুই জানতাম না। বিকেল ৪টার দিকে একজন আত্মীয় ফোন দিয়ে জানায় এখানে এনেছে।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে একে একে পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্স। সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছে মাইলস্টোন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রবিন হোসেন নাবিল, যার পুরো শরীর পুড়ে গেছে। তার মা নাসিমা আক্তার বারবার ছেলের জন্য আহাজারি করছিলেন।

আরও পড়ুন | “আমি কী জবাব দেব সেই অভিভাবকদের” — জাতীয় ট্র্যাজেডি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার আবেগঘন বার্তা

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহেরিনকে খুঁজে পাওয়া যায় ২-৩ ঘণ্টা পর। তার মুখ ও দুই হাত পুড়ে গেছে। তাঁর চাচা ফায়াদ নিয়ন জানান, “শিক্ষকরাই খুঁজে বের করেন মাহেরিনকে।”

উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিল দুর্ঘটনার পর প্রাথমিক চিকিৎসার প্রথম কেন্দ্র। সেখানেও ছিল কান্না আর আর্তনাদের দৃশ্য। উত্তরা বাসিন্দা পারভিন বেগম সন্ধ্যায় ছুটে আসেন তাঁর ছোট বোন সায়মা আক্তারকে খুঁজতে। তিনি বলেন, “ওর বাবা-মা তখনও এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরছেন।”

হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক এস এম রকিবুল হাসান জানান, প্রায় ১৬০ জন আহত এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৪০–৪৫ জনের অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক, ৭০–৮০ শতাংশ শরীর দগ্ধ। গুরুতরদের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট পরিদর্শনে গিয়ে সন্ধ্যা ৮টায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মো. সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, “এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৭ জন নিহত হয়েছেন, যাদের সবাই শিশু। আহতদের মধ্যে ২৫ জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন, ৯ জন আইসিইউতে।”

আরও পড়ুন: প্রথম একক উড্ডয়নে মর্মান্তিক মৃত্যু, উত্তরার দুর্ঘটনায় পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম

তিনি আরও বলেন, “অধিকাংশ আহতই শিশু। চিকিৎসার জন্য সব হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে, সব চিকিৎসক ও নার্সদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা মেডিকেল টিম দায়িত্বে থাকবে।”

সরকারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সব বেসরকারি হাসপাতাল দুর্ঘটনার শিকারদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবে। এ ব্যয়ের দায়িত্ব সরকার নেবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক মইনুল আহসান।

এই মুহূর্তে ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন শতাধিক আহত। আর সেইসব হাসপাতালের করিডোরে, কক্ষে, বারান্দায় বেদনায় নুয়ে পড়া স্বজনেরা প্রহর গুনছেন, কখন ফিরবে তাদের প্রিয়জন, অথবা ফিরবে কি আদৌ। উত্তরার আকাশে এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে কান্নার গুঞ্জন।

  • বিষয়াদি সম্পর্কে আরও পড়ুন:
  • ঢাকা

RELATED NEWS

Latest News