মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার ঘোষণা করেছেন, তিনি ১২টি দেশের কাছে চূড়ান্ত বাণিজ্য প্রস্তাব স্বাক্ষর করেছেন, যেগুলো অনুযায়ী ওই দেশগুলোকে উচ্চহারে শুল্ক দিতে হতে পারে। এই শুল্ক হার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
এ প্রস্তাবগুলো সোমবার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি কোন দেশগুলো এই তালিকায় রয়েছে, তা প্রকাশ না করলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভারতও এই তালিকায় থাকতে পারে। কারণ, মার্চ থেকে শুরু হওয়া টানা আলোচনার পরও ভারত–যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো কার্যকর বাণিজ্য সমঝোতা হয়নি।
ভারতের বিরুদ্ধে শুল্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনা
নয়াদিল্লিভিত্তিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন এখন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, “ট্রাম্পের আশা অনুযায়ী ফল না আসায় ভারতের নাম তালিকায় থাকা অস্বাভাবিক নয়।”
ভারতের প্রধান আলোচক রাজেশ আগরওয়ালের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ২৬ জুন থেকে এক সপ্তাহ ধরে ওয়াশিংটনে আলোচনায় অংশ নেয়। আলোচনায় মূলত একটি ‘প্রাথমিক চুক্তি’ নিয়ে অগ্রগতি আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু মার্কিন পক্ষের কৃষিপণ্যের জন্য পূর্ণ প্রবেশাধিকার দাবি এবং জেনেটিকালি মডিফায়েড পণ্যের ওপর ভারতের নিষেধাজ্ঞা—এই দুটি ইস্যুতে মতপার্থক্য থেকেই যায়।
কৃষি ও গাড়ি খাতে অচলাবস্থা
ভারত তার কৃষিখাত, বিশেষ করে জিএম খাদ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যে মার্কিন প্রবেশাধিকার দিতে রাজি নয়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় গাড়ি খাতে শুল্কমুক্ত প্রবেশ চায়, কিন্তু নিজ দেশের পক্ষ থেকে স্টিল ও গাড়ি খাতে আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
এই পরিস্থিতিতে ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ছাপিয়ে বিষয়টি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-তে নিয়ে যায়। ৩ জুলাই ভারত WTO-কে জানায়, ৩০ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর শর্তসাপেক্ষে শুল্ক অব্যাহতি বাতিল করতে পারে।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও সংশ্লিষ্ট আরেকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “ভারতের স্বার্থ নিশ্চিত করা গেলে এখনো জুলাই ৯-এর মধ্যে একটি প্রাথমিক চুক্তি হতে পারে।”
তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “ভারত এমন কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না, যা সমতাভিত্তিক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং পারস্পরিক লাভজনক নয়।”
উল্লেখ্য, ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৈঠকে দুই দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
ট্রাম্পের একতরফা শুল্ক নীতি
মার্চে যুক্তরাষ্ট্র সকল দেশের ওপর স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এরপর ২৬ মার্চ ট্রাম্প যাত্রীবাহী গাড়ি ও বিভিন্ন গাড়ি খুচরা যন্ত্রাংশে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেন, যার লক্ষ্য ছিল ভারতসহ কয়েকটি নির্দিষ্ট দেশ।
এপ্রিলের ২ তারিখে ট্রাম্প ‘লিবারেশন ডে’ ঘোষণা করে সমস্ত দেশের জন্য ১০ শতাংশ মৌলিক শুল্ক আরোপ করেন, এর পাশাপাশি ভারতের জন্য অতিরিক্ত ১৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়। সব মিলিয়ে ভারতের জন্য মোট শুল্ক দাঁড়ায় ২৬ শতাংশ।
যদিও এই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল, কিন্তু তা ৯ জুলাই শেষ হতে যাচ্ছে। ভারতের পক্ষ থেকে সব শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি করা হলেও, পরবর্তীতে কৃষিপণ্যে আংশিক ছাড়ের বিনিময়ে কিছু শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বাণিজ্যমন্ত্রীর অবস্থান ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
শনিবার ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বলেন, “ভারত কখনো সময়সীমা দিয়ে চুক্তি করে না। আমরা শক্ত অবস্থান থেকেই আলোচনা করি।”
তিনি বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীর অভিযোগের জবাবে বলেন, “মোদি সরকার কোনো সময়মেয়াদে মাথা নত করে না। আগের ইউপিএ সরকারই জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছিল।”
তিনি আরও বলেন, “চুক্তি তখনই ঘোষণা করা হবে, যখন তা সম্পূর্ণ চূড়ান্ত, সুষ্ঠু ও দেশের স্বার্থে হবে।”
বিশ্ববাজারে প্রতিক্রিয়া
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা জানান, তারাও এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে তারা বিদ্যমান বাণিজ্য ব্যবস্থাকে বাড়ানোর দিকে ঝুঁকছেন যাতে শুল্ক বৃদ্ধির ধাক্কা এড়ানো যায়।
ট্রাম্পের এই নতুন শুল্ক চাপ এবং ভারতের দৃঢ় অবস্থানের ফলে আগামী সপ্তাহগুলোতে বাণিজ্য আলোচনায় নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। এখন দেখার বিষয়, আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি সম্ভব হয় কিনা, নাকি দুই দেশের মধ্যে শুল্ক যুদ্ধ আরও তীব্র হয়।