Monday, November 10, 2025
Homeখেলাধুলাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে ঢাকায় সিরিয়ার তীরন্দাজ ইয়োলান্ডার শান্তির বার্তা

যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে ঢাকায় সিরিয়ার তীরন্দাজ ইয়োলান্ডার শান্তির বার্তা

২৪তম এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে সিরিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে লড়ছেন ইয়োলান্ডা গনজালেজ গালুল

৪১ বছর বয়সী ইয়োলান্ডা গনজালেজ গালুল। ঢাকার তপ্ত রোদে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ধনুক হাতে, চোখ স্থির দূরের টার্গেটে। অনেকের কাছে তীরন্দাজি কেবল একটি খেলা, কিন্তু ইয়োলান্ডার কাছে এটি টিকে থাকার প্রতীক—এবং যুদ্ধ-পরবর্তী জীবনের এক শান্ত বার্তা।

সিরিয়ার এই তীরন্দাজই বর্তমানে ঢাকায় অনুষ্ঠিত টি-আর ২৪তম এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। তাঁর কাঁধে শুধু তীর-ধনুক নয়, বহন করছেন যুদ্ধ, নির্বাসন ও টিকে থাকার কাহিনি।

“এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে পেরে আমি ভীষণ আনন্দিত,” বললেন ইয়োলান্ডা হাসিমুখে। “এটাই আমার প্রথম মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট।”

এর এক সপ্তাহ আগেই কাতারে অনুষ্ঠিত ওয়েস্ট এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি সিরিয়ার হয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছেন। “আমাদের স্কোর ছিল স্বর্ণজয়ীর সমান, কিন্তু টাইব্রেকারে হেরে যাই। তবুও সেটি আমার প্রথম পদক, সিরিয়ার জন্য।”

তবে এই সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর বেদনা। “যুদ্ধে আমরা ৫০ জনের বেশি আত্মীয়কে হারিয়েছি,” শান্ত গলায় বললেন তিনি। “আমার বাবার চাচাতো ভাইয়ের পরিবারকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। আমার ভাইকে বন্দি করা হয়েছিল, পরে মুক্তি পায় কারণ তার স্প্যানিশ পাসপোর্ট ছিল—না হলে তাকেও মেরে ফেলত।”

সিরিয়ান বাবা ও স্প্যানিশ মায়ের সন্তান ইয়োলান্ডা ভাগ্যক্রমে পেয়েছেন দ্বৈত নাগরিকত্ব—যা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ২০১১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রায় এক বছর বোমা ও গুলির মধ্যে আটকে ছিলেন, পরে ২০১২ সালে পালিয়ে যান স্পেনে।
“ওরা আমাদের খুঁজছিল,” স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। “স্পেন আমাদের আশ্রয় দিয়েছে—আমাদের বাঁচিয়েছে।”

এক দশকেরও বেশি সময় পর আজ তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনের পথে থাকা এক নতুন সিরিয়াকে।

দুই সন্তানের জননী ইয়োলান্ডা কাজ, পরিবার ও খেলাধুলা একসঙ্গে সামলান অবিচল মানসিকতায়। তাঁর ছোট মেয়ে ইতিমধ্যেই তীরন্দাজ হতে চায়। “এটা সহজ নয়,” স্বীকার করলেন তিনি। “তীরন্দাজি ৯০ শতাংশ মানসিক খেলা। এটা নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। কাজ ও সন্তান সামলাতে অনুশীলনের সময় কম পাই, কিন্তু এখন আবার র‍্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

খেলাধুলা বরাবরই তাঁর জীবনের অংশ। “আমি ১০ বছর দৌড়বিদ ছিলাম, ছোট ও দীর্ঘ দূরত্বে অনেক পদক জিতেছি। সিরিয়ায় বাস্কেটবল খেলতাম, পরে দুবাইয়ে গিয়ে ক্রসফিটেও অংশ নিয়েছি। তাই খেলা আমার কাছে নতুন নয়।”

তবু তীরন্দাজি তাঁর কাছে আলাদা কিছু। “আমি ভাবিনি এই খেলা এতটা টানবে। এটা মানসিক খেলা। অন্য খেলায় অ্যাড্রেনালিন তোমাকে তাড়ায়, কিন্তু এখানে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। স্থিরতা, মনোযোগ—এটাই আসল। এটা নিজের সঙ্গে এক যুদ্ধ।”

যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশের পতাকা হাতে একা দাঁড়িয়ে তিনি বহন করছেন এক প্রতীকী বার্তা—হার না মানার বার্তা।
“বাংলাদেশ আমাদের খুব আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে,” বললেন তিনি। “এখানকার পরিবেশ দারুণ। আমি সবসময় এশিয়া ভ্রমণের স্বপ্ন দেখতাম।”

যে নারী সবকিছু হারিয়েও সাহস হারাননি, তাঁর জন্য ঢাকায় দাঁড়িয়ে তীর ছোড়া কেবল প্রতিযোগিতা নয়—এটা এক নীরব প্রতিবাদ, এক শান্তির ঘোষণা।

শেষে ইয়োলান্ডার কণ্ঠে দৃঢ়তা, “এখন সিরিয়া শান্তি চায়। আমিও তাই চাই।”

RELATED NEWS

Latest News