গোপন ফোনালাপে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষার্থী আন্দোলনে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই ফোনালাপ প্রকাশিত হয়, যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট) জানায়, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা ফোনে বলেন, “আমার নির্দেশ আগেই দেওয়া হয়েছে। এখন ওরা মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করবে, যেখানেই পাবে গুলি করবে।”
এই ফোনালাপ ১৮ জুলাই জাতীয় টেলিযোগাযোগ নজরদারি কেন্দ্র (এনটিএমসি) রেকর্ড করে। একই কথোপকথনে শেখ হাসিনা ঢাকার দক্ষিণের তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে বলেন, আন্দোলনকারীদের মোকাবেলায় হেলিকপ্টার ব্যবহার হচ্ছে।
সেই সময়ে সরকারি বাহিনী আকাশপথে গুলি চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করলেও ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. শব্বির শরীফ জানান, তাদের হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়।
আন্দোলনের সময় নিহত ছাত্র আবু সাইয়েদের মৃত্যুকে ঘিরে আরও তথ্য উঠে এসেছে। শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের আরেক গোপন ফোনালাপে দেখা যায়, তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শকের সঙ্গে সায়েদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করছেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রাজীবুল ইসলাম জানান, পুলিশ তাঁকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাঁচবার বদলাতে বাধ্য করে যাতে একাধিক গুলির ক্ষতের কথা না থাকে।
নিহতদের পরিবারকে ঢাকায় এনে গণভবনে এক অনুষ্ঠানেও উপস্থিত করানো হয়, যেখানে হাসিনা প্রত্যেককে আর্থিক সহায়তা দেন। নিহত আবু সায়েদের বোন সুমি খাতুন সেই সময় বলেন, “ভিডিওতে দেখা গেছে পুলিশ গুলি করেছে। এখানে আর তদন্তের কী আছে?”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “তিনি (হাসিনা) জানতেন যে ফোনালাপ রেকর্ড হচ্ছে, তবু বারবার বলেছেন, ‘জানি, জানি, সমস্যা নেই।’ এখন নিজেই সেই ফাঁদে পড়েছেন।”
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইসিটি শেখ হাসিনা ও আরও দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করেছে। বিচার শুরু হবে আগষ্ট মাসে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ফোনালাপটি বিকৃত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নির্বাচিত হতে পারে। তারা দাবি করে, শেখ হাসিনা কখনো ‘lethal weapons’ শব্দ ব্যবহার করেননি এবং সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেননি। তাছাড়া সায়েদের মৃত্যুর তদন্ত প্রক্রিয়াকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত’ বলেও অভিহিত করা হয়।
২০২৪ সালের জুনে বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেছিল শিক্ষার্থীরা। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সায়েদের মৃত্যুর পর সেই আন্দোলন রূপ নেয় জাতীয় গণআন্দোলনে, যা সরকারবিরোধী ক্ষোভকে আরও উসকে দেয়। এই আন্দোলন ও সহিংস দমন অভিযানে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত ও ২০,০০০ জনের বেশি আহত হয় বলে আইসিটির তথ্যসূত্রে জানা গেছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এবং আল জাজিরা প্রকাশিত গোপন রেকর্ড দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখন বিচার প্রক্রিয়া কী দিকে মোড় নেয়, তা দেখার বিষয়।