একসময় ঘৃণার প্রতীক হিসেবে পরিচিত শব্দ ‘রাজাকার’ নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন ব্যাখ্যা পেয়েছে। ১৪ জুলাই ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনে এই শব্দ ফিরে আসে—তবে ভিন্ন এক রূপে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘রাজাকার’ বলতে বোঝানো হতো পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের। তাদের নামের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মস্বার্থ আর স্বাধীনতাবিরোধী মানসিকতা।
কিন্তু গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক প্রভাষ আমিন কোটা সংক্রান্ত আলোচনায় বলেন, “যদি সমান যোগ্যতাসম্পন্ন দুই প্রার্থী থাকে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, অন্যজন রাজাকারের সন্তান—আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকেই বেছে নেব।”
তার বক্তব্যের জবাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন করেন, “তাহলে কি বোঝানো হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা মেধাহীন, আর রাজাকারদের সন্তানরাই মেধাবী?”
এই মন্তব্যেই শুরু হয় ক্ষোভ। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে হাজারো শিক্ষার্থী। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে নতুন স্লোগান—
“চেয়ে ছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার”
“তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!”
এই স্লোগানগুলো ছিল বিদ্রুপের, ক্ষোভের, আবার একই সঙ্গে প্রতিবাদেরও। রাজাকার শব্দকে নতুন করে ব্যবহার করে তারা যেন এক দুঃসাহসিক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ইতিহাস বিভাগের ছাত্র রাকিব হোসেন বলেন, “আমরা সেদিন ‘রাজাকার’ শব্দটাকে দখল করি, যারা আমাদের উপর অন্যায় করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অস্ত্র বানাই।”
তিনি বলেন, “৩০ শতাংশ কোটা ধরে রাখার দাবি ছিল আমাদের মূল আপত্তি। এটা মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা নয়, বরং যুক্তির পক্ষে আন্দোলন ছিল।”
রাকিব জানান, রাত ৯টার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল বের হতে শুরু করে। ফেসবুক গ্রুপে আলোচনা হচ্ছিল, মন্তব্য ছড়িয়ে পড়ছিল দ্রুত।
তার ভাষায়, “যেখানে এক সময় ‘রাজাকার’ মানে ছিল বিশ্বাসঘাতক, সেখানে সেদিন তার মানে দাঁড়ায় প্রতিবাদ। আমাদের চুপ করানোর চেষ্টা যখন ‘রাজাকার’ বলে, তখন আমরা সেটাকেই প্রতিরোধের প্রতীক বানাই।”
নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেনি। বরং ইতিহাসের অপব্যাখ্যা, রাজনীতিকরণ এবং বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ভাষা হিসেবে তারা ব্যবহার করেছে এই শব্দকে।
১৪ জুলাই তাদের জন্য ছিল ইতিহাসের পুনর্নির্মাণের দিন—যেখানে একটি ঘৃণার শব্দ রূপ নেয় শক্তিশালী প্রতিবাদের ভাষায়।