মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর থেকে দেশটিতে খাদ্যাভাব ও শিশুমৃত্যু বেড়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। অভ্যন্তরীণ ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা ও বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো এখন অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
দুই বছরের ছেলে হারানোর শোকে পিতা মোহাম্মদ তাহের বলেন, এপ্রিল থেকে তাদের ক্যাম্পে খাদ্যরেশন বন্ধ থাকায় তার ছেলে অপুষ্টি ও ডায়রিয়ায় মারা গেছে। “আমার সন্তানসহ অনেক শিশু না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কংগ্রেসে দাবি করেছেন, তাদের সাহায্য বন্ধের ফলে কেউ মারা যায়নি। এই বক্তব্যকে “মিথ্যা” বলে আখ্যায়িত করেছেন তাহের।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, মিয়ানমারের ৪০ শতাংশ জনগণ বর্তমানে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। একসময় যুক্তরাষ্ট্র দেশটির বৃহত্তম মানবিক দাতা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ইউএসএআইডি (USAID) বিলুপ্ত করার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে শিশুরা
তাহেরের মতো হাজার হাজার পরিবার রাখাইন রাজ্যের ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় আছে। খাদ্যরেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিন বেলার খাবার এখন এক বেলায় নেমে এসেছে। শিশুরা অনাহারে, অসুস্থ আর চিকিৎসাহীন অবস্থায় মৃত্যুর মুখে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) জানিয়েছে, এপ্রিলে তারা এক মিলিয়ন মানুষের খাদ্য সহায়তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। রাখাইনে খাদ্য নিরাপত্তাহীন পরিবারের সংখ্যা ডিসেম্বর ২০২৪ সালের ৩৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
কিছু মা ঘাস দিয়ে তৈরি পাতলা স্যুপ খাইয়ে সন্তানদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন ডব্লিউএফপি–র মিয়ানমার পরিচালক মাইকেল ডানফোর্ড। তিনি বলেন, “মানুষের হতাশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেউ কেউ মৃত্যুকেই মুক্তি হিসেবে দেখছে।”
আত্মহত্যা ও সামাজিক বিপর্যয়
খাদ্যরেশন বন্ধ হওয়ার পর ক্ষুধা ও হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন দুই সন্তানের জনক মোহাম্মদ এলিয়াস। তার ছেলে বলেন, “আমার বাবা মনে করতেন মৃত্যু হয়তো ক্ষুধার চেয়ে সহজ।”
ক্যাম্পগুলোতে চুরি ও সহিংসতাও বেড়েছে। মানুষ বনে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাবার খোঁজে, কেউ কেউ নদীর পানি খেয়ে ক্ষুধা ভুলে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা “বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা” অব্যাহত রেখেছে এবং অন্যান্য দেশকেও অবদান বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, তহবিল বন্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও গরিব জনগোষ্ঠী।
বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের সভাপতি তুন খিন বলেন, “এই তহবিল বন্ধ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যার নীতিকে আরও সহায়তা করছে।”
অসহায় জীবনের শেষ আশা
থাইল্যান্ড–মিয়ানমার সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া মাহমুদ করমার বলেন, “আমরা প্রায় মরে যাচ্ছি। খাওয়ার কিছু নেই, কাজও নেই।” তিনি প্রতিদিন জঙ্গলে গিয়ে খাবার সংগ্রহ করেন, আর রাতে ক্ষুধার্ত সন্তানদের জন্য উদ্বেগে জেগে থাকেন।
তহবিলের অস্থায়ী নবায়ন হলেও ডিসেম্বরের পর তা শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে বর্ডার কনসোর্টিয়াম। এরপর কী হবে, কেউ জানে না।
মাহমুদের মতো হাজারো পরিবার এখন শুধু আশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের বিশ্বের দিকে। তিনি বলেন, “যদি সহায়তা না ফেরে, আমরা সবাই ধীরে ধীরে মরে যাব।”