ঢাকার উত্তরা এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত শিশু শিক্ষার্থীরা এখনো হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পরিবার-পরিজনেরা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে প্রার্থনা করছে, অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে অপারগতায়।
সোমবারের এই দুর্ঘটনায় দগ্ধ ও আহত ৫৭ জনকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার ৮৯ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হলেও বুধবার আরও ১৩ জনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সবচেয়ে গুরুতর অবস্থায় থাকা ১৩ জন বর্তমানে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে রয়েছে ১৪ বছরের মাহতাব, ১৫ বছরের মাহিয়া, ১২ বছরের জারিফ, ১৮ বছরের সাইমন, ১২ বছরের নাভিদ, ১২ বছরের আকিব, ১৬ বছরের তকরিমসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ও স্কুলের এক শিক্ষক ও কর্মচারী। চিকিৎসকদের মতে, তাদের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক।
বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান সোমবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনাস্থলে ২০ জনের মৃত্যু ঘটে। পরদিন মঙ্গলবার মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১-এ। বুধবার ভোররাতে নয় বছরের নাফি মারা যাওয়ায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ জনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত ২২টি মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শনাক্ত করতে না পারা সাতটি মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ১১ জনের কাছ থেকে।
বুধবার সারাদিন স্কুল চত্বরে সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। শুধু শিক্ষকরা জরুরি বৈঠকের জন্য প্রবেশের অনুমতি পান। প্রতিষ্ঠানটির তিনটি গেটের সামনে অনেক সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী, শুভানুধ্যায়ী এবং উৎসুক জনতা ভিড় করলেও তাদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ স্কুলটি আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে নিহত, আহত ও নিখোঁজদের তালিকা প্রস্তুতের জন্য অধ্যক্ষ মো. জিয়াউল আলমের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, তাদের হাসপাতালে ৪৪ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জনের অবস্থা সংকটজনক, ১৩ জন গুরুতর এবং ২৩ জন মাঝারি পর্যায়ের দগ্ধ।
তিনি জানান, “সিঙ্গাপুর থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রতিটি কেস আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা পরপর সব রোগীর অবস্থা পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।”
রক্ত সংকটের গুজব ছড়িয়ে পড়লে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, কোনো রক্তের গ্রুপের সংকট নেই। যারা সাহায্য করতে চান, তারা ঢাকার উপ-সিভিল সার্জন ডা. ফারহানা কবিরের সঙ্গে ০১৭৯২৭৪৪৩২৫ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করার অভিযোগ ছড়ালে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।
আইএসপিআর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামিউদ্দৌলা চৌধুরী বলেন, “মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে অনলাইনে অনেক গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যা ভিত্তিহীন। দুর্ঘটনার পরই সেনাবাহিনী দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা তথ্য গোপন করছি না। যে কেউ তদন্ত করতে চাইলে স্বাগত জানাই। সেনা কর্মকর্তা, আহত ব্যক্তি বা তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমরা সর্বাত্মক সহায়তা করতে প্রস্তুত।”
তবে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইএসপিআরের তথ্য ভিন্নতা রয়েছে। মঙ্গলবার আইএসপিআর ৩১ জনের মৃত্যুর তথ্য দিলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২৭ জনের কথা জানায়। বুধবার সকালে নাফির মৃত্যু হলে অধিদপ্তরের হিসাব ২৯ জনে দাঁড়ায়। তবে রিপোর্ট লেখার সময় (বুধবার রাত ৮টা ৩০ মিনিট) পর্যন্ত আইএসপিআরের পক্ষ থেকে নতুন কোনো হালনাগাদ দেওয়া হয়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে উত্তরা সেক্টর ১২ কবরস্থানে মরদেহ দাফনের উদ্যোগ থাকলেও বুধবার বিকেল পর্যন্ত সেখানে কোনো দাফন হয়নি।
সেক্টর ১২ কবরস্থানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম জানান, “আমরা ২০টি মরদেহ আসবে বলে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো মরদেহ এখানে দাফনের জন্য আনা হয়নি।”
অনেক পরিবারই তাদের প্রিয়জনদের নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে বা নির্বাচিত কবরস্থানে দাফন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এই দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শিশুরা এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, আর তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি নিঃসঙ্গ জাতি, যাদের চোখে শুধুই প্রার্থনার জল।