বাংলাদেশের ডিজিটাল ও নাগরিক পরিসরের ওপর প্রভাব ফেলেছে এমন ৬ মাসব্যাপী পর্যবেক্ষণ ও নথিপত্রের ভিত্তিতে প্রকাশিত “মিডিয়া মনিটরিং রিপোর্ট”-এ উঠে এসেছে নারীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল হয়রানি, সাংবাদিক নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা এবং আইনগত স্বচ্ছতার অভাব।
শনিবার রাজধানীর হোটেল লা ভিঞ্চিতে আয়োজিত এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে রিপোর্টটি উপস্থাপন করেন VOICE-এর উপপরিচালক মুশাররাত মাহেরা।
এই উদ্যোগে সহযোগিতা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড এবং ARTICLE 19। রিপোর্ট বাস্তবায়ন করেছে VOICE এবং দৈনিক ইত্তেফাক।
আলোচনার মূল বিষয়
আলোচকরা জানান, একদিকে যেমন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য হয়েছে, তেমনি এগুলো এখন হয়রানি, মিথ্যা প্রচারণা ও বিশেষ গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে আক্রমণের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
VOICE-এর নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, “জুলাই আন্দোলনের সময় নারী ছিলেন সামনের সারিতে, কিন্তু আগস্টের পর আমরা দেখেছি তারা পেছনে চলে গেছেন। এটি শুধু সমাজতাত্ত্বিক নয়, ডিজিটাল বিভ্রান্তি ও টার্গেটেড মিথ্যাচারের ফল।”
তিনি অভিযোগ করেন, “প্রাচীন সুফি মাজারগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে, যার পেছনে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইচ্ছা ছিল। এই সহিংসতা রোধে রাষ্ট্রের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ ছিল না।”
মাহমুদ আরও বলেন, “একাধিক আইন তৈরি হচ্ছে যেমন CSA, DPA, AI পলিসি, কিন্তু সেগুলোর প্রভাব পড়বে নাগরিকদের ওপর অথচ সেখানে তাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই।”
সাংবাদিকতা ও তথ্যপ্রবাহে দুর্বলতা
বাংলা ট্রিবিউনের সিটি এডিটর উদিসা ইসলাম বলেন, “মজুরি বোর্ড আছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। মালিকরা নিজস্ব মিডিয়া খুললেও সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখছেন না।”
মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন
মানবাধিকার কর্মী রিয়াজুর রহমান লেনিন বলেন, “গত ১০ মাসে কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি বা পুলিশ হেফাজতে ১০ জনের বেশি মারা যায়নি— এমন দাবি বিভ্রান্তিকর। অধিকারের মত সংস্থাগুলোর রিপোর্টেও এসব ভুল তথ্য রয়েছে।”
লিঙ্গভিত্তিক ডিজিটাল বিভ্রান্তি
ওয়ান ফিউচার নেটওয়ার্কের গবেষক মহপারা আলম বলেন, “নারীদের নিয়ে কটূক্তি হলে দ্রুত ফেসবুকে গণ-ট্রায়াল শুরু হয় এবং এসব বিষয় নির্দিষ্ট এক প্যাটার্নে প্রচারিত হয়। সাংবাদিক বা অ্যাকটিভিস্ট নারী হলে তাদের নিয়ে গুজব ছড়ানো আরও বেশি হয়।”
তিনি সমাধান হিসেবে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ডিজিটাল সাক্ষরতা অন্তর্ভুক্তির কথা বলেন।
পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা
VOICE-এর উপপরিচালক মুশাররাত মাহেরা বলেন, “আদালত ও পুলিশের ফলোআপ পর্যবেক্ষণ আমাদের প্রকল্পের আওতায় ছিল না। এছাড়া স্থানীয় মিডিয়ার তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি, এবং জেন্ডার বিভ্রান্তি বিষয়ক তথ্য কেবল ফেসবুক ভিত্তিক ছিল।”
রিপোর্টে উল্লিখিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
অক্টোবর ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত সময়কালে রিপোর্টে উঠে এসেছে:
ময়মনসিংহে সাংবাদিক স্বপন ভদ্র খুন
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক প্রদীপ চৌধুরী আটক
জামালপুরে দৈনিক স্টারের প্রতিনিধি শাহিদুল ইসলাম নিরবের ওপর হামলা
১৬৭ সাংবাদিকের প্রেস কার্ড বাতিল
নারী সাংবাদিক মুন্নি সাহার ওপর হুমকি ও হেনস্তা
রূপগঞ্জে সাংবাদিক জাহাঙ্গীর মাহমুদের বাসায় হামলা
কবি সোহেল হাসান গালিবের গ্রেফতার
আদিবাসী সাংবাদিক জুয়েল মারাকের ওপর হামলা
ঢাকা পলাশীতে নারী সাংবাদিকের গণধর্ষণের ঘটনা
গুজব ও ডিজিটাল বিভ্রান্তি
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে,
নুসরাত তাবাসসুমকে ভুয়া ভিডিও দিয়ে হয়রানি
প্রেস সচিবের কন্যার বিরুদ্ধে ডিপফেক ভিডিও প্রচার
মেহজাবিন ও সায়েদা রিজওয়ানার বিরুদ্ধে এআই-সম্পাদিত ছবি
পূজা চেরিকে ছাত্রশিবিরের উপদেষ্টা হিসেবে মিথ্যা প্রচার
তাসনিম জারা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সংযোগ স্থাপন
আইনি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা
সাইবার সেফটি অর্ডিন্যান্স ২০২৪ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এতে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার ও তল্লাশির সুযোগ রাখা হয়েছে। “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” সংক্রান্ত ধারার অপব্যবহার করে ভিন্নমত দমন করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইনে সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব থাকলেও পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রিপোর্টটি তুলে ধরে, ডিজিটাল ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় বিদ্যমান আইন ও নীতিমালায় স্পষ্টতা ও কার্যকর প্রয়োগের অভাব রয়েছে। নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় প্রয়োজন সুসংহত ও অংশগ্রহণমূলক নীতি বাস্তবায়ন।