গত বসন্তে কাশ্মীরের বারামুলা জেলার সানগরি টপ ওয়াটলাব এলাকায় রিয়াজ আহমেদ ভাটের সরিষার খেত প্লাবিত হয় ব্রিটিশ আমলের একটি খালের পানিতে। এরপরের গ্রীষ্মে অতিরিক্ত তাপদাহে শুকিয়ে যায় তার শালিমার নামের জনপ্রিয় ধানজাত ফসল।
এ বছর আবারও ধান চাষ করলেও ভাট জানান, যে খালটির মাধ্যমে সেচের পানি আসার কথা ছিল, সেটি এখন প্রায় শুকনো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কাশ্মীরে গ্রীষ্মকাল আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে, যার ফলে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ জলসংকট।
এই পরিস্থিতিতে, ভারতের পক্ষ থেকে ইন্দাস জলচুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত কাশ্মীরবাসীর মধ্যে নতুন করে আশা জাগিয়েছে। এপ্রিল মাসে পহেলগামে এক জঙ্গি হামলার পর ভারত ১৯৬০ সালের ইন্দাস চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়।
চুক্তি অনুযায়ী, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মোট ছয়টি নদীর পানির ভাগ ৮০:২০ হারে বিভক্ত। ইন্দাস, ঝেলাম ও চেনাব নদী বরাদ্দ পাকিস্তানের জন্য, আর রবি, বিয়াস ও শতদ্রু ভারতের জন্য। ভারতের দাবি, প্রকৃতিক পরিবর্তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে তাদের ন্যায্য হিস্যা কমে গেছে।
শ্রীনগরের আবহাওয়া অনেকটাই বদলে গেছে। একসময় শীতল উচ্চভূমি হিসেবে পরিচিত এই শহরে এখন প্রচণ্ড গরম পড়ে এবং ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা যায়।
কাশ্মীরের বিখ্যাত জাফরান চাষও হুমকির মুখে, কারণ প্রকল্প নেওয়া হলেও ৬০ শতাংশ এলাকায় সেচব্যবস্থা কার্যকর নয় বলে ২০২১ সালে কেন্দ্রকে জানানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইন্দাস চুক্তি ও বিদ্যুৎ বিক্রির পদ্ধতির কারণে রাজ্য বঞ্চিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা তানভীর হুসেইন।
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জানুয়ারির প্রথমার্ধে বৃষ্টি হয়নি, আর ডিসেম্বরে বৃষ্টির ঘাটতি ছিল ৮০ শতাংশ। ফলত আপেল, সরিষা ও অন্যান্য ফলজ ফসলে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
ভাটের খামারের কাছেই থাকা সাজিদ মীর জানান, গত বছর তার গ্রামে প্রথমবারের মতো খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। সরিষা ফলনও বিপর্যস্ত হয়। অক্টোবর ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত মৌসুমি বৃষ্টিপাত ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৪ শতাংশ কম।
তিনি বলেন, “আমাদের চাহিদা মেটানোর পরেই যেন অন্য রাজ্য বা পাকিস্তানে পানি দেওয়া হয়। পাকিস্তানি কৃষকরা আমাদের নদীর পানিতেই চাষবাস করে।”
জলচুক্তি বাতিলের পর কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ একে ‘অন্যায্য দলিল’ বলে আখ্যা দেন। একই সুর শোনা যায় ব্যবসায়ীদের মুখেও।
শ্রীনগরের রেসিডেন্সি রোডের হোটেল মালিক ফারুক দার বলেন, “৯০-এর দশকে আমার বাবা রাজ্য সরকারকে পানির সংকট নিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। সেখানে ইন্দাস চুক্তির অসাম্যতার কথাও ছিল।”
বদলে যাওয়া আবহাওয়া শীতকে করেছে কঠিন, গ্রীষ্মকে শুষ্ক। শীতকাল সাধারণত তিন ধাপে বিভক্ত: চিল্লাই কালান, চিল্লাই খোর্ড ও চিলে বাচি।
স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের মুখতার আহমেদ বলেন, “চিল্লাই কালানেই মূলত তুষারপাত হয়, কিন্তু গত কয়েক বছরে তুষারপাত কমে গেছে।”
ফলে অনেক কৃষক ধান ছেড়ে ফলের বাগানমুখী হচ্ছেন।
গত বছর গুলমার্গে তুষারপাত ছিল খুবই কম। অথচ এশিয়ার বৃহত্তম স্কি রিসোর্ট হিসেবেই এটি পরিচিত।
এক প্রশাসনিক সূত্র জানায়, কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চলে উৎপাদিত বিদ্যুতের মাত্র ১৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয় নিজ রাজ্যে, বাকি অংশ বিক্রি হয় বাইরে।
কাশ্মীরের ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। পাহাড়ি অঞ্চলের কৃষকরা তুষার গলন হওয়া পানির উপর নির্ভর করেন। কিন্তু গরম বেড়ে যাওয়ায় হিমবাহ দ্রুত গলে যাচ্ছে, ফলে সেচ ও কৃষিকাজ দুই-ই ব্যাহত হচ্ছে।
শেরে কাশ্মীর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিজ্ঞানী ফারহাত আমিন বলেন, “ইন্দাস জলচুক্তিকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে দেখা হলেও, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাশ্মীর।”
প্রেজেন্টেশন কনভেন্ট স্কুলের শিক্ষিকা আমব্রিন শেখ বলেন, “এই অবিচার অনেক হয়েছে, এখনই সময় তা সংশোধনের।”