সিলেটের কানাইঘাট পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রায় পাঁচ বছর পর হাইকোর্টের নির্দেশে রিকাউন্টে উল্টে গেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএস সোহেল আমিন আসলে ৬৮৪ ভোট বেশি পেয়েছিলেন, যেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত লুৎফুর রহমানকে ১৪৬ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল।
২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কানাইঘাট পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মেয়র পদে সোহেল আমিনসহ একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
তৎকালীন ফলাফল অনুযায়ী, কানাইঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুর রহমান সোহেল আমিনকে ১৪৬ ভোট হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন।
কিন্তু সোহেল আমিন ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ব্যাপক ভোট কারচুপি ও ব্যালট ম্যানিপুলেশনের অভিযোগ তুলে রিকাউন্টের দাবিতে আবেদন করেন।
বছরের পর আইনি লড়াইয়ের পর সিলেটের এক আদালত বিচারকের উপস্থিতিতে ম্যানুয়াল রিকাউন্ট করে। এতে দেখা যায়, সোহেল আমিন ৬৮৪ ভোটের স্পষ্ট লিড পেয়েছিলেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে সোহেল আমিন বলেন, “সরকারি হস্তক্ষেপে আমাকে পরাজিত করা হয়। আদালতের রিকাউন্টে লুৎফুর রহমানের বান্ডেলে ৫৫৪টি ফাঁকা ব্যালট পাওয়া যায়। আরও অনেক অনিয়ম ছিল। আশা করি আদালত এখন আমাকে বৈধ মেয়র ঘোষণা করবে।”
আদালতের রিকাউন্ট অনুযায়ী, ‘জগ’ (কলসি) চিহ্নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সোহেল আমিন তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৬৮৪টি বৈধ ভোট বেশি পেয়েছিলেন। ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, তিনি ৩,৬৮৬ ভোট পেয়ে ১৪৬ ভোটে হেরে যান।
তৎকালীন রিটার্নিং অফিসার ও জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফয়সাল কাদের ‘নৌকা’ চিহ্নে লুৎফুর রহমানকে ৩,৮৩২ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
মোট ছয়জন প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এমএন নিজাম উদ্দিন (‘নারকেল গাছ’ চিহ্ন) ৩,০৬৩ ভোটে তৃতীয়, বিএনপির এমএ শরিফুল হক (‘ধানের স্তূপ’ চিহ্ন) ২,৫২০ ভোটে চতুর্থ, স্বতন্ত্র কাওসার আহমেদ (‘মোবাইল ফোন’ চিহ্ন) ৬১৩ ভোটে পঞ্চম এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নাজির আহমেদ (‘হাতপাখা’ চিহ্ন) ২১২ ভোটে ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন।
সোহেল আমিন পরে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। তিনটি পোলিং সেন্টার—ফাতাহিজল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিবনগর দারুল কুরআন মাদ্রাসা এবং দুর্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ করেন।
২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট লুৎফুর রহমানের গেজেট ও শপথ গ্রহণ আটক করে আট সপ্তাহের জন্য। পরে অ্যাপিলেট ডিভিশনের চেম্বার জজের আপিলে সেই আদেশ স্থগিত হয়। ফলে রহমান মেয়র পদে যোগ দেন।
তিনি ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত পদে ছিলেন। পরে তাকে অপসারণ করা হয়।
২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশন সিলেট নির্বাচন ট্রাইব্যুনালকে ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়। কিন্তু প্রক্রিয়া দু’বছরেরও বেশি লাগে।
আদালত কর্মকর্তাদের মতে, চূড়ান্ত রায় কয়েক দিনের মধ্যে আসবে।
২০২৫ সালের ১০ নভেম্বর আদালত তিনটি বিতর্কিত পোলিং সেন্টারের ব্যালট রিকাউন্ট করে। এর মধ্যে ফাতাহিজলের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। সেখানকার প্রেসাইডিং অফিসার শাহাওয়াত হোসেনকে হাইকোর্ট আদলে ডেকে ব্যাখ্যা চেয়েছিল।
ফাতাহিজলে মোট ২,৭১১ ভোট পড়েছিল। স্থানীয় পরিসংখ্যানে ৫২৯ জন নিবন্ধিত ভোটার প্রবাসী এবং কয়েকজন মৃত। সব জীবিত বাসিন্দা ভোট দিলেও মোট ২,১৮২ ভোট হওয়ার কথা। কিন্তু তথ্য অনুযায়ী ২,৬১১ ভোট পড়ে। সোহেল আমিন এটিকে ‘ভূত ভোট’ বলে ব্যালট স্টাফিংয়ের প্রমাণ বলে দাবি করেন।
সোহেল আমিন আরও অসঙ্গতি তুলে ধরেন: “ফাতাহিজলে আমার আসলে ৬৬৬ ভোট ছিল, কিন্তু রেকর্ডে ২৬৯। দুর্লভপুরে ৭১৩ ভোট পেলাম কিন্তু দেখানো হয়েছে ৫১৩, এবং শিবনগর মাদ্রাসায় ২৮৯ ভোট পেলেও রেকর্ডে মাত্র ৮৯।”
কয়েক দিনের মধ্যে আদালতের চূড়ান্ত রায় আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি কানাইঘাট পৌরসভা নির্বাচনের অফিসিয়াল ফলাফল উল্টে দিতে পারে—প্রায় পাঁচ বছর পর।
