২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন সৃজনশীলতার মাধ্যমে অনন্য রূপ পায়। প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় গণবিপ্লবে। সেই সময়ের স্মরণীয় ঘটনাগুলোতে স্লোগান, পোস্টার, গ্রাফিতি, কার্টুন এবং গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে যেকোনো আন্দোলনের প্রথম স্বীকৃতি আসে রাস্তাঘাট থেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগেও মানুষ কীভাবে একত্রিত হচ্ছে, তা স্লোগান ও মিছিলে বোঝা যায়। শুরুতে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয়, “কোটা না মেধা? মেধা, মেধা” এবং “আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই।”
১৪ জুলাই রাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনকারীদের রাজাকারদের সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেন, তখন ঢাকার শিক্ষার্থীরা রাতেই স্লোগান তোলে, “তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার” এবং “চাইতে এলাম অধিকার, হইয়া গেলাম রাজাকার।” এরপর আওয়ামী লীগপন্থী সংগঠনগুলো আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলে শিক্ষার্থীরা পাল্টা স্লোগান দেয়, “লাখো শহীদের দামে কেনা, দেশটা কারো বাপের না।”
১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সায়ীদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে নতুন স্লোগান জন্ম নেয়। শিক্ষার্থীরা মিছিল করে বলে, “আমার খাই আমার পরি, আমার বুকেই গুলি কর” এবং “তোদের কোটা তোরা নে, আমার ভাইকে ফেরত দে।” এই সময় পুলিশের কঠোর অবস্থানের বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে, “কে এসেছে কে এসেছে, পুলিশ এসেছে, কী করছে কী করছে, স্বৈরাচারের পা চাটছে।”
আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্রসংগঠনের হামলার পর শিক্ষার্থীরা নতুন স্লোগান দেয়, “জনে জনে খবর দে, ছাত্রলীগের কবর দে” এবং “সন্ত্রাসীদের আস্তানা, ক্যাম্পাসে হবে না।” ২৫ জুলাই থেকে “তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প” স্লোগান উঠে আসে, যা শেখ হাসিনার বিকল্প নেই— এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। এরপর আন্দোলনের স্লোগান হয়, “আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম” এবং “দলালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ।”
পুলিশ, বিজিবি এবং র্যাবের গুলিতে নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিও জোরালো হয়। মিছিলে শোনা যায়, “এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়” এবং “দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ।” জনগণকে ঢাকায় যোগ দিতে আহ্বান জানানো হয় স্লোগানে, “ঢাকায় আসো জনগণ, ছাড়তে হবে ক্ষমতা।” ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করলে আনন্দে স্লোগান ওঠে, “পলাইছে রে পলাইছে, শেখ হাসিনা পলাইছে।”
এ আন্দোলনে অসংখ্য স্লোগান সৃষ্টি হয়, যা শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতিই নয়, সময়ের সংস্কৃতির প্রতিফলনও ঘটায়। জুলাই আন্দোলনের ইতিহাস বুঝতে এই স্লোগানগুলো এক ধরনের দিনপঞ্জির মতো কাজ করে। আন্দোলনের ধাপে ধাপে রূপান্তর এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা কীভাবে বদলেছে, তা স্লোগানগুলো থেকেই স্পষ্ট হয়।