আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ অনেকটাই ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকরা। সোমবার মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ সভাপতির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লিতে প্রত্যর্পণের অনুরোধ নতুন করে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে এবং সেখানে পালিয়ে যাওয়া একাধিক নেতাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তার মতে, এ বাস্তবতা ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের একটি দরকষাকষির হাতিয়ার হতে পারে। তিনি বলেন, ভৌগোলিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ ভারতের প্রভাব পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারবে না। সরকারকে বোঝাতে হবে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বাংলাদেশি জনগণের বৃহত্তর প্রত্যাশা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, বাস্তবে ভারত শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করবে না বলেই স্পষ্ট। তারপরও রায় একটি নতুন ভিত্তি দিয়েছে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরার। তিনি মনে করেন, বিচার প্রক্রিয়াটি ন্যায়বিচারের জন্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়— সরকারকে এ বার্তা আরও দৃঢ়তার সঙ্গে দেখাতে হবে। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়ে নোট ভার্বাল পাঠানোর পরও ভারত সাড়া দেয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে আরও ফলো আপ চিঠি পাঠানো উচিত ছিল।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির জানান, প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক ও আইনি দুটো দিক আছে। ২০১৩ সালের দ্বিপক্ষীয় প্রত্যর্পণ চুক্তির ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ ভারতের জন্য আইনি ফাঁকফোকর অনুসন্ধানের সুযোগ রাখলেও তিনি মনে করেন ভারত আইনি বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেবে। তার ভাষ্য, বাংলাদেশ নোট ভার্বাল পাঠিয়েছে, রায় ও নতুন অনুরোধের পর এখন ভারতের প্রতিক্রিয়ার পালা।
ইন্টারপোলের সহায়তা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অনুরোধ পাঠানো হলেও শেখ হাসিনা ও কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী–এমপিসহ মোট ২৪ পলাতক আসামির বিরুদ্ধে আট মাসেও রেড নোটিশ জারি হয়নি। সংশ্লিষ্ট ইউনিটের সূত্র জানায়, কেন দেরি হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। সাধারণত সব নথিপত্র যাচাই শেষে ইন্টারপোল তিন সপ্তাহের মধ্যেই মতামত জানায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ট্রাইব্যুনালের রায়ে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া যে কোনো দেশের পক্ষেই ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বিদ্যমান প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ভারত সরকারের আইনি দায়বদ্ধতা রয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় এবং দুই দণ্ডিতকে অবিলম্বে বাংলাদেশে হস্তান্তরের আহ্বান জানানো হয়।
আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, ঢাকার পক্ষ থেকে আবারও দিল্লিতে লিখিত অনুরোধ পাঠানো হবে। তিনি বলেন, ভারত যদি এই দণ্ডিত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়ে যেতে চায়, তবে এটিকে বাংলাদেশ ও তার জনগণের বিরুদ্ধে বৈরিতার কাজ হিসেবে দেখা হবে। তার বক্তব্য সরকারের অবস্থানকে উদ্ধৃত করে উপস্থাপিত হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন, আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কূটনৈতিক যোগাযোগই এখন নির্ধারণ করবে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ার গতি। ভারতের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না আসা পর্যন্ত বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়েছে।
