আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কাশ্মীরের পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ফের উত্তপ্ত ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। প্রতিক্রিয়ায় ভারত সীমান্ত পেরিয়ে সামরিক হামলা চালায়। এরপরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, “পাকিস্তানকে আর পানি দেওয়া হবে না।”
এই ঘোষণার পর ভারত সাময়িকভাবে ইন্দাস পানি চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। চুক্তিটি ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং কয়েকটি যুদ্ধের মধ্যেও তা কার্যকর ছিল। তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত এলে সংঘর্ষ কিছুটা থেমে যায়। কিন্তু মোদির পানি বন্ধের হুঁশিয়ারি থেকেই যায়। প্রশ্ন উঠছে, ভারত কি আসলেই পাকিস্তানের পানি বন্ধ করতে পারবে?
ইন্দাস পানি চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের জন্য বরাদ্দ তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী: রাভি, বেয়াস ও শতলুজ। আর পাকিস্তান পায় পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদীর পানি: ইন্দাস, ঝিলাম ও চেনাব। পাকিস্তানের প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিভূমি এই নদীগুলোর উপর নির্ভরশীল। কৃষিই দেশটির মোট জিডিপির প্রায় এক চতুর্থাংশ, যেখানে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কর্মরত।
অর্থাৎ পানিপ্রবাহে সামান্য ব্যাঘাতও হতে পারে বিশাল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ।
তবে বাস্তবতা হলো, এই চুক্তি এমনভাবে তৈরি যেখানে কোনো পক্ষ ইচ্ছেমতো চুক্তি বাতিল করতে পারে না। ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে কোনো বিরোধ প্রথমে স্থায়ী ইন্দাস কমিশনের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। দরকার হলে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ বা আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগও রয়েছে।
বর্তমানে ভারত চুক্তির বাইরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও পানিপ্রবাহ বন্ধ করেনি। তবে শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ কমিয়ে দেওয়া বা হঠাৎ করে সিল্ট (কাদা-পলি) ছেড়ে পাকিস্তানের কৃষিভূমিতে ক্ষতি করার সম্ভাবনা থাকছে। যদিও তা সরাসরি চুক্তি লঙ্ঘন না হলেও তাৎপর্যপূর্ণ কূটনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারে।
কিন্তু এতে ভারতের ওপরও বিপরীত প্রভাব পড়তে পারে।
কারণ পাকিস্তানের অন্যতম মিত্র চীন। দেশটি পাকিস্তানের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে এবং তিব্বতের উৎস থেকে ইন্দাস ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। ২০১৬ সালে ভারত যখন পানি বন্ধের হুমকি দেয়, তখন চীনও পাল্টা পদক্ষেপে ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রবাহ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।
চীন বর্তমানে তিব্বতে বিশাল একটি বাঁধ নির্মাণ করছে ইয়ারলুং সাংপো নদীতে, যা ভারতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। ভারত যদি পাকিস্তানের পানিতে হস্তক্ষেপ করে, চীনও ভারতের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে।
ফলে মোদির বক্তব্য যতই কঠোর হোক না কেন, বাস্তবে তা কার্যকর করা আইনগত, কূটনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট জটিল।
একজন জলনীতি বিশ্লেষক জানান, “শুধু বলার জন্য বলা সহজ। কিন্তু আন্তর্জাতিক চুক্তির কাঠামোর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা এতটা সহজ নয়।”
এ ছাড়া ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। যদি বড় ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে ভারত তার ছোট প্রতিবেশীকে পানি দিয়ে চাপে ফেলতে চায়, তবে তা আন্তর্জাতিক সমর্থন হারানোর কারণ হতে পারে। আবার এমন পদক্ষেপে কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ফলও নাও আসতে পারে।
কারণ পানি ধরা যায় না। সেটি সীমান্ত মানে না। যেদিকে খোলা থাকে, সেদিকেই চলে যায়।
এই কারণে হুমকিটি জটিল। শুধু পানি নয়, এটি ইতিহাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের বিষয়। মোদির হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হলেও বাস্তবতা বলছে, কাজটা অত সহজ নয়।
এমনকি দীর্ঘশ্বাসের মতো অনুভূত হয়—ভারতই সেই কাঠামোর একসময় নির্মাতা, যেটি এখন তার হাতকেও বাঁধছে।
সেই কাঠামো এখনো বলছে: সহযোগিতা লড়াইয়ের চেয়ে ভালো। ভবিষ্যতে এই ভারসাম্য কতটা টিকে থাকবে, সেটা আর কথা দিয়ে নয়, কাজ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে।