মধ্য মে-তে প্রাক-বর্ষার বৃষ্টিতে বেঙ্গালুরুর কিছু অংশ হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে যায়। মুম্বাইয়ে বর্ষা নির্ধারিত সময়ের এক সপ্তাহ আগেই আঘাত হানে, নতুন মেট্রো স্টেশন প্লাবিত হয় এবং ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। দিল্লির সড়কজুড়ে পানির ঢল স্থায়ী যানজট সৃষ্টি করে, স্যুয়েজ উল্টো প্রবাহিত হয়। গুরগাঁও আবারও ‘গুরুজ্যাম’ হিসেবে ট্রেন্ড করে—বাড়িঘর প্লাবিত, সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলনা চলে ভেনিসের সঙ্গে।
এই দৃশ্যগুলো যতই আতঙ্কজনক হোক, ভারতীয় শহরবাসীর জন্য এখন যেন চিরচেনা। ২০০৫ সালে মুম্বাইয়ে একশ বছরে একবার হওয়া এমন বৃষ্টিতে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও, তার পরবর্তী দুই দশকে বর্ষায় শহরগুলো প্লাবনের শিকার হতে থাকা বন্ধ হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হঠাৎ বৃষ্টির তীব্রতা বাড়লেও, শহরগুলোর প্রস্তুতি ও অবকাঠামোগত দুর্বলতাই সংকটকে ঘনীভূত করছে। পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সমস্যার সমাধান দূরে থাক, বছর বছর তা আরও গভীর হচ্ছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ব্রিটিশরা যখন দিল্লিকে রাজধানী করছিল, তারা প্লাবনপ্রবণ এলাকা বাদ দিয়ে রাইসিনা পাহাড়ের উঁচু জায়গা বেছে নেয়। অথচ স্বাধীনতার পর নগরায়ন হয়েছে নদীর প্লাবনভূমিতে—যেখানে স্বাভাবিকভাবেই জল জমে।
চেন্নাইয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুরনো শহরের পরিকল্পিত অংশে ড্রেন এখনো কাজ করে। কিন্তু নিচু এলাকাগুলো, যা আগে ধানের জমি ছিল, সেখানেই জলাবদ্ধতা বেশি। মাটি কাদামাটির হওয়ায় পানি মিশে যেতে পারে না, আর আকৃতিগত বাধার কারণে স্বাভাবিক প্রবাহ থেমে যায়।
মুম্বাইয়ের মতো শহরে ভূমি পুনরুদ্ধার করা এলাকাগুলো বেশি জলাবদ্ধ হয়। ভাটার সময় যদি তীব্র বৃষ্টির সঙ্গে পড়ে, তাহলে পানি জমে থাকে অনেকক্ষণ। দিল্লিতে বড় রাস্তাগুলোর পিলার ও মেট্রো লাইনগুলো জলপ্রবাহ আটকে দেয়। আগে যেখানে পানি যমুনায় গিয়ে পড়ত, এখন তা শহরেই জমে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে নদীর কারণে প্লাবন হতো, এখন শহরের ভেতরেই ‘ইন-সিচু’ জলাবদ্ধতা দেখা যায়। বেঙ্গালুরু যেমন পাহাড়ি মালভূমিতে অবস্থিত, তবুও সেখানে বারবার প্লাবন হয়। এর কারণ নগর পরিকল্পনার ভুল।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রকৃতি উপেক্ষিত হয়েছে। গবেষণা বলছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতের ১০টি বড় শহরের গড়ে ৪৭% জমি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৫% জলাভূমি হারিয়ে গেছে। এসব উন্নয়ন হয়েছে এমন জায়গায়, যেখানে প্রাকৃতিকভাবে পানি মাটির নিচে মিশে যেত।
এভাবে পানি মাটি না ঢুকতে পারায় এবং সঠিক নিকাশি না থাকায় প্রতিটি বর্ষায় শহরগুলো পানিতে ডুবে যাচ্ছে। স্টর্ম ড্রেইন ও স্যুয়ারের জন্য একটিই চ্যানেল ব্যবহার করার ফলে স্লাজ জমে গিয়ে জলাবদ্ধতা আরও বাড়ে।
রাস্তাগুলোও পানি নির্গমনের কাজে লাগার কথা থাকলেও, বারবার ঢাল না রেখে রাস্তাগুলো পুনরায় নির্মাণের ফলে সেগুলোর উচ্চতা বেড়ে যায়, পাশের এলাকাগুলো নিচু থেকে যায়। এতে পানির সঠিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়।
পুরাতন শহরগুলোর যেমন ড্রেনেজ সমস্যা রয়েছে, তেমনি নতুন শহরগুলো হয়েছে কোনো প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা ছাড়াই। গুরগাঁওয়ের মত জায়গা কৃষিজমি থেকে শহর হয়েছে, যেখানে প্রাইভেট গেটেড কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। এসব কমিউনিটি নিজেদের বর্জ্য নিজেরা সামাল দেয়, কিন্তু অতিরিক্ত পানি রাস্তায় ফেলে দেয়।
দিল্লির মত শহরে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনায় নয়টি সংস্থা জড়িত। একটির ড্রেন যদি পরিষ্কার না থাকে, তাহলে অন্য সংস্থার ড্রেন থেকেও পানি উল্টো প্রবাহিত হয়। এই সমন্বয়হীনতাই বড় সমস্যা।
ড্রেন থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন কাদা তোলা হয়। কিন্তু তার নিষ্পত্তির সঠিক ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টির আগেই পরিষ্কার করা হলেও সেগুলো রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। প্রথম বৃষ্টিতেই সেগুলো আবার ড্রেনে ফিরে যায়।
নগর কর্তৃপক্ষ দায় নিচ্ছে বটে, কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী মেশিন, ট্রাক, জনবল থাকে না। যেসব পরিকল্পনা আছে, সেগুলো এখনো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।
সমাধান হিসেবে অনেকে ‘ন্যাচার-বেসড সলিউশন’ বা NBS-এর কথা বলছেন। বেঙ্গালুরুর আশেপাশের জলাশয়গুলো পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা চলছে, চেন্নাইয়ে পুনরায় জলাভূমি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইসব প্রকৃতিক ভিত্তিক সমাধান অতিবর্ষণের সময় যথেষ্ট নয়। তবে এগুলো শহরের তাপমাত্রা হ্রাস ও ভূগর্ভস্থ পানির পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।
তবে এসব প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। প্রাকৃতিক ড্রেনগুলোকে খনন করতে হয়, স্পঞ্জ পার্কে পুনরায় গাছ লাগাতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ড্রেনে যেন ময়লা, আবর্জনা ও রাস্তার পানি অপরিশোধিতভাবে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
জলবায়ু সহনশীল শহর গড়তে শহরগুলোর জন্য প্রয়োজন জলপ্রবাহের হাইড্রোলজিক্যাল ম্যাপিং, পর্যাপ্ত অর্থায়ন, এবং কার্যকর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। মুম্বাইয়ের মত শহর ইতোমধ্যে IIT বোম্বের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। কলকাতা শহর ব্রিটিশদের তৈরি পুরনো ইটের ড্রেন সংস্কারে জোর দিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কলকাতা ২০ লাখ মেট্রিক টন স্লাজ তুলেছে, নতুন লাইনিং দিয়েছে এবং ৮২টি পাম্পিং স্টেশন চালু করেছে, যা শহর থেকে পানি বের করতে সহায়তা করছে।
শেষ পর্যন্ত, নাগরিক সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা সম্ভব নয়, বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শহরের কাঠামো ঠিক রাখতে হলে নগর কর্তৃপক্ষকে পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে দরকার সুপরিকল্পিত ও বহুমাত্রিক সমাধান, যাতে শহর বাঁচে এবং নাগরিকরাও নিরাপদ থাকে।