গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত অংশ ও হামাস শাসিত এলাকার মধ্যে কার্যত একটি বিভক্ত বাস্তবতায় স্থায়ী রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গৃহীত যুদ্ধবিরতি-পরবর্তী পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ স্থবির হয়ে পড়ায় পুনর্গঠনের কাজ ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত অংশে সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনাই এখন বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউরোপীয় কূটনীতিকরা।
পরিকল্পনার প্রথম ধাপ ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়ার পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে দক্ষিণের রাফাহ, গাজা সিটির কিছু অংশ ও উল্লেখযোগ্য কৃষিজমি রয়েছে। বাকি অংশে প্রায় ২০ লাখ মানুষ তাঁবুপল্লি ও বিধ্বস্ত নগর এলাকায় জীবনযাপন করছে, যা হামাসের নিয়ন্ত্রণে।
পরবর্তী ধাপে ইসরায়েলের হলুদ লাইন নামে পরিচিত সীমা থেকে আরও পিছু হটার কথা, সঙ্গে গাজা শাসনে একটি অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষ ও বহুজাতিক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং পুনর্গঠনের সূচনা। কিন্তু এই ধাপে বাস্তবায়নের সময়সীমা বা প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করা নেই। হামাস নিরস্ত্রীকরণে রাজি নয়, ইসরায়েল পশ্চিমা সমর্থিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পিএ কোনো ভূমিকা মানতে নারাজ এবং বহুজাতিক বাহিনী নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
মানামার নিরাপত্তা সম্মেলনে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেন, সবাই একই লক্ষ্য চায়, প্রশ্ন হলো কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র একটি জাতিসংঘ প্রস্তাবের খসড়া করেছে যাতে বহুজাতিক বাহিনী ও অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষকে দুই বছরের ম্যান্ডেট দেওয়া হবে, তবে অনেক সরকারই সৈন্য পাঠাতে অনাগ্রহী। ইউরোপীয় ও আরব দেশগুলো বিশেষত শান্তিরক্ষা সীমার বাইরে গিয়ে হামাস বা অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায় না।
ময়দানে বাস্তবতা আরও কঠিন। ইসরায়েল গাজার নিজ নিয়ন্ত্রিত অংশে হলুদ রঙের কংক্রিট ব্লক বসিয়ে প্রত্যাহার লাইন চিহ্নিত করেছে এবং শেজাইয়া এলাকায় সেনাচৌকি মজবুত করেছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র নাদাভ শোশানি জানান, হামাস নিরস্ত্রীকরণের শর্ত পূরণ হলে এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন হলে ইসরায়েল আরও পিছু হটবে।
ইসরায়েলি সরকারের বক্তব্য, তারা চুক্তি মেনে চলছে এবং অচলাবস্থার দায় হামাসের। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েলের গাজা পুনর্দখলের উদ্দেশ্য নেই, তবে সীমান্তে বাফার জোন বজায় রাখা হবে।
অন্যদিকে গাজার ফিলিস্তিনি এলাকাগুলোতে হামাস সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পুনরায় প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের পুলিশ ও বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবীরা বাজারের নিরাপত্তা এবং ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে নিয়োজিত।
হামাসের মুখপাত্র হাযেম কাসেম বলেন, পুনর্গঠন শুরু করতে একটি ফিলিস্তিনি প্রযুক্তিবিদভিত্তিক সত্তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা প্রস্তুত, এবং গাজার সব অঞ্চলের পুনর্গঠনে সমতা থাকা উচিত। আলোচনায় থাকা একটি ধারণা হলো আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে অস্ত্র নিষ্ক্রিয়করণ, যা সরাসরি ইসরায়েল বা অন্য বাহিনীর কাছে অস্ত্র হস্তান্তরের বিকল্প হতে পারে।
ইউরোপীয় ও আরব দেশগুলো চায়, পিএ ও তার পুলিশ বাহিনী বহুজাতিক বাহিনীর সঙ্গে গাজায় ফিরে এসে হামাসের পরিবর্তে দায়িত্ব নিক। মিসর ও জর্দানে প্রশিক্ষিত হাজারো সদস্য প্রস্তুত বলেই জানানো হচ্ছে, তবে ইসরায়েল পিএ’র সম্পৃক্ততায় আপত্তি জানাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভেট কুপার সতর্ক করেছেন, গাজা যেন শান্তি ও যুদ্ধের মাঝামাঝি এক অনির্ধারিত অবস্থায় আটকে না যায়।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের মাইকেল ওয়াহিদ হান্না উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত অংশে এককভাবে পুনর্গঠন শুরু হলে বর্তমান ভাঙা বাস্তবতা দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
অর্থায়ন নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলো পিএ’র সম্পৃক্ততা এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট পথ ছাড়া ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত অংশে পুনর্গঠন তহবিল দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। পুনর্গঠন ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার। জর্ডান বলছে, গাজা অবিভাজ্য, এটি দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অংশ। ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারসেন আগাবেকিয়ান শাহিনও গাজাকে ভাগ করার ধারণা প্রত্যাখ্যান করে জানান, পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ছাড়া টেকসই স্থিতিশীলতা সম্ভব নয় এবং পিএ পূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।
বর্তমান স্থিতাবস্থা চলতে থাকলে হলুদ লাইনই গাজাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কার্যত বিভক্ত রেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরও ধাক্কা লাগবে এবং মানবিক সঙ্কট দীর্ঘায়িত হবে, কারণ অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় ও খাদ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভরশীল অবস্থায় রয়েছেন।
