Thursday, October 30, 2025
Homeজাতীয়কক্সবাজার বিমানবন্দর জেনারেটর দুর্নীতি: বিচার ঝুলিয়ে রেখে অভিযুক্তদের পেনশন নেওয়ার অভিযোগ

কক্সবাজার বিমানবন্দর জেনারেটর দুর্নীতি: বিচার ঝুলিয়ে রেখে অভিযুক্তদের পেনশন নেওয়ার অভিযোগ

আদালতে গরহাজির অভিযুক্ত প্রকৌশলী ও ঠিকাদার, তদন্ত কর্মকর্তাও নিষ্ক্রিয়; বিচার প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে নজিরবিহীন অচলাবস্থা

কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর সরবরাহ সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বিচার অচলাবস্থায় আটকে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এক ঠিকাদার বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে পূর্ণ পেনশন সুবিধা আদায়ের ষড়যন্ত্র করছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সূত্রমতে, মামলার প্রধান অভিযুক্ত বেবিচকের প্রকৌশলী শহিদুল আফরোজ এবং ভবেশ চন্দ্র রায়ের পাশাপাশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনালের’ মালিক শাহাবুদ্দিন বারবার আদালতের শুনানি এড়িয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে মামলার কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর এবং ২২ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য থাকলেও অভিযুক্তদের কেউই আদালতে হাজির হননি। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন, অভিযুক্তরা অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মামলাটি ঝুলিয়ে রাখার জন্য এটি একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল। যাতে অবসর গ্রহণের পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কার্যকর না হয়।

তদন্তকারী এবং বেবিচকের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো সন্দেহ করছে যে, বিএনপি-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদার শাহাবুদ্দিন বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করছেন। মামলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, “যতবারই আদালত তারিখ নির্ধারণ করে, তাদের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি কোনো না কোনো অজুহাতে অনুপস্থিত থাকেন। এটি পরিষ্কারভাবেই সমন্বিত একটি প্রচেষ্টা।”

এই অচলাবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক মাহবুবুল হকের কয়েক মাস ধরে অনুপস্থিতি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর মাহবুবুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল বলে জানা গেছে, যার ফলে মামলাটির কার্যকর তদারকি বা ফলো-আপ বন্ধ হয়ে আছে।

বিচারের আগেই অবসর

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত দুই প্রকৌশলীই কৌশলগতভাবে সময়ক্ষেপণ করছেন। দুর্নীতির মামলা অমীমাংসিত থাকা সত্ত্বেও ভবেশ চন্দ্র রায় এরই মধ্যে অবসরে গিয়ে শতভাগ পেনশন সুবিধা পেয়েছেন, যা অনেককে বিস্মিত করেছে। এখন অনেকেই সন্দেহ করছেন, প্রকৌশলী শহিদুল আফরোজও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগে একই পথ অবলম্বনের চেষ্টা করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেইলি সানকে বলেন, “আমলাতান্ত্রিক ফাঁকফোকর ব্যবহার করে জবাবদিহি থেকে পালানোর এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।”

২০২৩ সালে “কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর সরবরাহে মহাচুরি” শিরোনামে একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের পর দুদক এই মামলাটি (নম্বর ৮৬১/২০১৯) দায়ের করে। প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয় যে, বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঠিকাদার জেনারেটর সরবরাহ না করেই ৬ মিলিয়ন টাকা তুলে নিয়েছেন।

ঘটনাটি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের, যখন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ঢাকা ইন্টারন্যাশনালকে একটি জেনারেটরের জন্য ৯ মিলিয়ন টাকার কার্যাদেশ দেয়। কিন্তু সরঞ্জাম সরবরাহ না করেও তৎকালীন ব্যবস্থাপক হাসান জহির, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহিদুল আফরোজ, নির্বাহী প্রকৌশলী মিহির চাঁদ দে এবং সহকারী প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্র রায়ের সহায়তায় শাহাবুদ্দিন বিলের অর্থ তুলে নেন।

ব্যাপক সমালোচনার পর দুদক তদন্ত শুরু করে এবং ২০২৩ সালে অভিযোগপত্র দাখিল করে, যা আদালত গ্রহণ করে। কিন্তু অভিযুক্ত কর্মকর্তারা আপিল করলে হাইকোর্ট প্রথমে ছয় মাস এবং পরে দুইবার মেয়াদ বাড়িয়ে প্রায় দুই বছর বিচারকাজ স্থগিত রাখে।

বেবিচকের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত

মামলাটি বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও বেবিচক বিতর্কিতভাবে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাদের নতুন পদে পদায়ন করে। সাবেক বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক হাসান জহিরকে ফায়ার সার্ভিসে বদলি করা হয় এবং আফরোজ, দে এবং রায়সহ অন্যদের বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়।

একপর্যায়ে প্রকৌশলী মিহির চাঁদ দে তার বরখাস্তের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে একটি পৃথক মামলা (নম্বর ৪৪৫/২০২৩) দায়ের করলেও বেতন-ভাতা আটকে যাওয়ায় তা প্রত্যাহার করে নেন। অভ্যন্তরীণ সূত্রমতে, এই পদক্ষেপটিই সকল অভিযুক্তকে পুনর্বহালের মাধ্যমে “পুরস্কৃত” করার পথ প্রশস্ত করে।

অভিযুক্তদের আদালত এড়ানো, তদন্ত কর্মকর্তার বরখাস্ত এবং একজন মূল আসামির পূর্ণ সুবিধাসহ অবসরে যাওয়ায় কক্সবাজার বিমানবন্দর জেনারেটর দুর্নীতি মামলাটি কার্যত একটি আমলাতান্ত্রিক অচলাবস্থায় পরিণত হয়েছে।

আইন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই মামলাটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে কীভাবে কর্মকর্তা, ঠিকাদার এবং প্রশাসনিক অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের পদ্ধতিগত যোগসাজশ দুর্নীতির বিচারকে নীরবে লাইনচ্যুত করতে পারে।

যেমনটি একজন সিনিয়র কর্মকর্তা সরাসরি বলেছেন: “এই মামলাটি আর জবাবদিহিতার বিষয় নয়, এটি এখন কীভাবে সিস্টেমকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায় তার লড়াই।”

RELATED NEWS

Latest News