Saturday, July 12, 2025
Homeজাতীয়গুম নিয়ে কমিশনের প্রতিবেদন: রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মামলার প্রবাহ পরিবর্তনের ইঙ্গিত

গুম নিয়ে কমিশনের প্রতিবেদন: রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মামলার প্রবাহ পরিবর্তনের ইঙ্গিত

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার, বিচার ব্যবস্থার রাজনৈতিক অস্ত্রায়ন ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে চাপের অভিযোগ

গুম সংক্রান্ত ঘটনার তদন্তে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিশন তাদের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের সঙ্গে আইনপ্রয়োগের ধরনে দৃশ্যমান সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯–এর অপব্যবহার এবং বিচার ব্যবস্থার রাজনৈতিক অস্ত্রায়নের অভিযোগ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

কমিশনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধী দল দমন নীতির অংশ হিসেবে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। একইভাবে, ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় দেশজুড়ে বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় মামলার নতুন ঢেউ দেখা যায়।

এর বিপরীতে, ২০২৩ সালে সরাসরি রাজপথে আন্দোলনের প্রবণতা বাড়লেও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলার হার কম ছিল। ২০২৪ সালের মধ্যে নতুন মামলার সংখ্যা আরও কমে আসে, যা কমিশনের মতে জাতীয় নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলোর সক্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

প্রতিবেদনে “Weaponised Criminal Justice System” শিরোনামে একটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বিচার ব্যবস্থা ও প্রসিকিউশন প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে বিরোধী মত দমন এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীকে জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়েছে।

কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ১৯৮ জন ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যা অন্য যেকোনো আইনের চেয়ে অনেক বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মামলা হয়েছে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ১৮৮৪ (৫১ জন) এবং অস্ত্র আইন ১৮৭৮ (৪৩ জন)–এর আওতায়।

তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮–এ ৯ জনের বিরুদ্ধে এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪–এ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, “আইনের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, বিশেষত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ওপর, একটি কাঠামোগত অপরাধীকরণের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে ব্যক্তিক নির্দিষ্ট প্রমাণ উপেক্ষিত হয়েছে।”

কমিশনের কাছে বিভিন্ন জেলার অসংখ্য ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যে এক ধরনের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে, যেখানে গুম বা নির্বিচার আটক হওয়া ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি আদায়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে চাপ দেওয়া হয়েছে।

সাক্ষাৎকারে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে নির্দিষ্ট কথাগুলো না বললে তাদের প্রাণনাশ, দীর্ঘ সময় গুম, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি ও আরও গুরুতর মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই আইনজীবীর উপস্থিতি না রেখেই জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে, যাতে কোনো আইনি সুরক্ষা কার্যকর না হয়।

কমিশন আরও জানিয়েছে, গত এক দশকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ একধরনের পুনরাবৃত্ত অভিযোগ ও অনুমানভিত্তিক ভাষা ব্যবহার করে, রাজনৈতিক বিরোধিতাকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

এতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সমালোচনা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধাচরণ বা প্রতিবাদী আন্দোলনের পক্ষে অনলাইন পোস্টকেও জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংযুক্ত করে মামলা হয়েছে, বিশেষত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার আওতায়।

কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, “এই ধরনের আইনি কাঠামো পূর্ববর্তী সরকারের রাজনৈতিক বক্তব্যকে নিরাপত্তার মোড়কে তুলে ধরার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে নয় বরং হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।”

প্রতিবেদনটি একদিকে অতীত শাসনামলে নিপীড়নের ধরনকে তথ্যভিত্তিকভাবে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্য ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবিকে আরও জোরালো করেছে।

RELATED NEWS

Latest News