দেশের দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদার করতে সরকার একটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর আওতায় খুলনা, বরিশাল এবং চট্টগ্রাম বিভাগের ১২টি জেলার ৪৭টি উপজেলায় ৯০টি নতুন তিনতলা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এই উদ্যোগটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের চলমান প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে “উপকূলীয় ও ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)” শীর্ষক এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে এর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে এবং এর মেয়াদকাল ২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারিত হয়েছে।
প্রকল্পের নথি অনুসারে, প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রের মোট ফ্লোর এরিয়া হবে ১,২৭২ বর্গমিটার। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রায় এক হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে, যার ফলে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রায় ৯০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা হবে।
এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো শুধুমাত্র ঘূর্ণিঝড়ের সময় মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজেই ব্যবহৃত হবে না, বরং স্বাভাবিক সময়ে এগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেও পরিচালিত হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে গভীর নলকূপের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সুবিধা থাকবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশের জন্য এই উদ্যোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘ওয়ার্ল্ড রিস্ক রিপোর্ট ২০২২’ অনুযায়ী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ বিশ্বে নবম এবং এশিয়ায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে। দেশের উপকূলীয় ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ১৭টি জেলায় প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ বসবাস করে, যাদের জন্য টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ একটি জাতীয় অগ্রাধিকার।
স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে ৪,৬৫৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। চলমান এই কর্মসূচির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে যথাক্রমে ১০০টি এবং ২২০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়। তৃতীয় পর্যায়ের এই উদ্যোগ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করবে।
প্রকল্পটির জন্য অর্থবছরের ভিত্তিতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৯৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩২০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ২১৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। মোট বাজেটের মধ্যে নির্মাণ খাতে ৫৩০ কোটি ৪৩ লাখ, আরসিসি রাস্তা নির্মাণে ২০ কোটি ৯২ লাখ, আসবাবপত্রের জন্য ১১ কোটি ৪০ লাখ এবং অন্যান্য খাতে ৫৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি সরাসরি রাজস্ব আয় না করলেও মানুষের জীবন, সম্পদ ও জীবিকা রক্ষা করে শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক প্রভাব ফেলবে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং টেকসই অবকাঠামো निर्माणসহ বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনেও সহায়ক হবে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ সহনশীলতা ও প্রকৌশল বিভাগ (ডিআরই) পরিচালিত এক সমীক্ষায় প্রকল্পটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা মনে করেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ঝুঁকি হ্রাস এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে উপকূলের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা এবং ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কৌশল পরিবর্তন করে। “দুর্যোগ পরবর্তী সাড়াদান” থেকে সরে এসে “সক্রিয় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা” নীতি গ্রহণ করে দেশটি, যা দুর্যোগ সংঘটনের আগেই প্রতিরোধের ওপর জোর দেয়। বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবনী পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী একটি অনুসরণীয় মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
