Wednesday, July 30, 2025
Homeজাতীয়চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা প্রকল্পে ব্যর্থতা, সমাধানে মাস্টারপ্ল্যানই একমাত্র উপায়

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা প্রকল্পে ব্যর্থতা, সমাধানে মাস্টারপ্ল্যানই একমাত্র উপায়

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব ও সমন্বয়ের ঘাটতিতে দুর্ভোগে শহরবাসী, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ‘ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান’ কার্যকর করা

চট্টগ্রাম শহরে একের পর এক হাজার কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন সত্ত্বেও বর্ষা মৌসুম এলেই পানিতে ডুবে থাকে নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা। দীর্ঘ সময় ধরে চলা কাজ, সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন ও নাগরিক সচেতনতার ঘাটতি মিলিয়ে জলাবদ্ধতা আজ এক দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে।

২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি করপোরেশন (সিসিসি) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যৌথভাবে চারটি বড় প্রকল্প হাতে নেয়। ১৪ হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্প ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো কাজ ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ অগ্রসর হয়েছে।

সাম্প্রতিক টানা বৃষ্টিতে আবারও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। যদিও কিছু এলাকায় খাল সংস্কারের ফলে পানি দ্রুত নামলেও চকবাজার, কাপাসগোলা, শোলকবহর, আগ্রাবাদসহ বহু এলাকায় জলাবদ্ধতা তীব্র রূপ নিয়েছে। পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূমিধসের আশঙ্কা থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের সরিয়ে নিতে কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

সিসিসির তথ্য অনুযায়ী, ৩৬টি খালের মধ্যে ২১টির খনন কাজ শেষ হয়েছে। তবে ১২টি খালের মধ্যে মাত্র চারটিতে রেগুলেটর গেট ও পাম্প হাউজ নির্মিত হয়েছে।

সিডিএ প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, কাজ যত এগোচ্ছে, তত জলাবদ্ধতা কিছুটা কমছে। তবে তিনি নিষ্পচনযোগ্য বর্জ্যকে জলাধার আটকে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

শহর পরিকল্পনাবিদ ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার মজুমদার বলেন, “পাহাড়ি মালিকদের জবাবদিহিতার আওতায় না আনলে ভূমিধসের ঝুঁকি থেকেই যাবে।”

নগরবাসীর অভিযোগ, অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা ও জনসাধারণের অসচেতনতা এই সমস্যাকে দীর্ঘতর করছে।

গত ১৪ অর্থবছরে তিনজন মেয়রের অধীনে সিসিসি প্রায় ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, এ অর্থের যথাযথ ব্যবহার হয়নি। বরং ‘দেখানোর জন্য’ কাজ হয়েছে, আর প্রকৃত সমাধান অধরাই থেকে গেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টিতে বৃষ্টির সাথে সাথে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে প্রায় ৩১ লাখ মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চাঁন্দগাঁও, শোলসোহর, চকবাজার, বাকলিয়া, আগ্রাবাদ, গোসাইল ডাঙ্গা ও হালিশহর।

সিসিসির প্রতিবছরের উন্নয়ন কাজের বাস্তবায়ন হার ১৭ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বহীন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়, যা টেকসই নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একমাত্র সমাধান হচ্ছে ১৯৯৫ সালের ‘চট্টগ্রাম স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল মাস্টারপ্ল্যান’ পুরোপুরি বাস্তবায়ন। তবে এখন এই পরিকল্পনা হালনাগাদ করাও প্রয়োজন।

জলাবদ্ধতার মূল কারণ:

  • পাহাড় কাটা থেকে খালে মাটি ও বালু পড়ে ভরাট

  • খাল ও ড্রেন দখল

  • আবর্জনা ফেলার স্থান হিসেবে খালের ব্যবহার

  • খালের মুখ উঁচু হওয়ায় জোয়ারে পানি বের হতে না পারা

  • অপরিকল্পিত নগরায়ন ও নিচু এলাকা ভরাট

সম্ভাব্য সমাধান:

  • কর্ণফুলী নদী খনন

  • খালের গভীরতা ও প্রস্থ বাড়ানো

  • খালে সিল্ট ট্র্যাপ বসানো

  • জোয়ার প্রতিরোধে গেট স্থাপন

  • আবর্জনা ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন

  • খাল দখলমুক্ত করা

  • পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন খাল নির্মাণ

  • নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি

  • ওয়ার্ড পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা

অন্তবর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগ:
চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিবেশ, সড়ক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও গৃহায়ন–এই চার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা দল চট্টগ্রামে পরিদর্শন করেন। তারা আটটি স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করেন, যার ফলে কিছু এলাকায় পানি দ্রুত নেমেছে।

তবে সিসিসি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জানিয়েছেন, নগরজুড়ে সম্পূর্ণ সমাধানে আরো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিডিএ, পোর্ট অথরিটি, ওয়াসা ও পাউবোসহ সব সংস্থাকে সিসিসির নেতৃত্বে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। একা সিসিসির পক্ষে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

RELATED NEWS

Latest News