গত এক বছরে ঋণ পুনঃতফসিল প্রক্রিয়ায় গড়িমসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বাংলাদেশে ৫০০টির বেশি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বা অচল হয়ে পড়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
কারখানা মালিকদের দাবি, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ পুনর্গঠনের প্রস্তাব জমা দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। অনেক উদ্যোক্তা অভিযোগ করেছেন, তারা সক্রিয় সহযোগিতার পরিবর্তে নানা ধরনের অনীহা ও জটিলতার মুখে পড়েছেন।
ঋণ পুনঃতফসিলে দেরির কারণে পুঁজি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নগদ অর্থের অভাবে বহু কারখানা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে, যা হাজার হাজার চাকরির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে। তবে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ (৫০ কোটি টাকার বেশি) পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ওই একক কমিটি অত্যন্ত ধীর গতিতে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোম্পানি আবেদন করেছে, কিন্তু মাত্র ২৮০টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “একটি কমিটি দিয়ে এত বিপুল সংখ্যক আবেদন সামলানো সম্ভব নয়। প্রতি বৈঠকে মাত্র তিন থেকে চারটি মামলা দেখা হয়। এভাবে চলতে থাকলে সব আবেদন নিষ্পত্তি করতে পাঁচ বছর সময় লাগবে।”
অর্থনীতিবিদ ও স্যানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যাপ্ত সহায়তা না থাকায় বহু প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। তার মতে, প্রকৃত ঋণগ্রহীতাদের দ্রুত সহায়তা দেওয়া এখন অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “আসল ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্জীবিত করতেই এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। মামলার সংখ্যা ও জটিলতার কারণে সময় লাগছে, তবে প্রক্রিয়া দ্রুত করার চেষ্টা চলছে।”
শিল্প পরিদর্শন সংস্থা ও শিল্প পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে অন্তত ৫০০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে কাজ না পেয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন।
প্রধানত তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার ও টেক্সটাইল খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এই সংকটে পড়েছে। কারখানা মালিকদের অভিযোগ, ঋণ পুনঃতফসিল ছাড়াও উচ্চ সুদহার, শ্রম অস্থিরতা, কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি জটিলতা, গ্যাস সংকট ও বাড়তি দাম, বিদ্যুতের অনিয়মিত সরবরাহ এবং শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধিই তাদের প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে ব্যর্থ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি চার টাকার মধ্যে এক টাকার বেশি এখন খেলাপি।
মাত্র তিন মাস আগেও (মার্চ ২০২৫) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এক ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক বছর আগের তুলনায় (জুন ২০২৪) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ঋণ পুনঃতফসিলের ধীরগতি ও অনিশ্চয়তা কেবল শিল্প খাতকেই নয়, সমগ্র ব্যাংকিং খাতকেই চরম ঝুঁকির মুখে ফেলছে।