জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) পাঁচ মাসব্যাপী সংলাপ শেষে ৮১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ হয়।
দ্বিতীয় ধাপে ১৯টি মূল বিষয়ে ঐক্যমত্য হয়, যেখানে পাঁচটিতে ভিন্নমত লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রথম ধাপের আলোচনাতেও কিছু ভিন্নমত নথিভুক্ত ছিল।
এনসিসি মনে করছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে একই টেবিলে এনে এতগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো একটি বড় অর্জন।
সংলাপ শেষে এনসিসির ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ঐক্যমত্যে পৌঁছেছি। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সংশোধিত খসড়া প্রস্তাব করতে বলা হয়েছিল, যা পরে গ্রহণ করা হয়েছে।”
দুই ধাপে কমিশন ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৬৭টি বৈঠক করেছে। প্রথম ধাপে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৪৪টি বৈঠক হয়। দ্বিতীয় ধাপে ২ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনায় অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এ বি পার্টি, এলডিপি, গণ অধিকার পরিষদ, গণফোরাম, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি, জাসদ, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও এনডিএম রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলগুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে দেশের শাসনব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসবে। রাজনৈতিক বিজ্ঞান গবেষক মুহাম্মদ মিরাজ মিয়া বলেন, “জনঅভ্যুত্থানের পর এত দ্রুত এতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া একটি বড় অর্জন। দলগুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে শাসনব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।”
তবে জুলাই চার্টারের বাস্তবায়ন ও অনুমোদন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন ইতিমধ্যে জানিয়েছে, আইনি ভিত্তি না থাকলে তারা জুলাই ন্যাশনাল চার্টার ২০২৫-এ সই করবে না। অন্যদিকে, সিপিবিসহ চারটি বামপন্থী দল বৃহস্পতিবার রাতেই নীতিগত কারণে সংলাপ বয়কট করেছে।
শুক্রবার শাহবাগ মোড়ে ‘জুলাই যোদ্ধারা’ দ্বিতীয় দিনের মতো আন্দোলন চালিয়ে যায়, চার্টার ও প্রোক্লেমেশন দ্রুত চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়ে। বৃষ্টির মধ্যেও তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। পুলিশ সন্ধ্যায় এসে তাদের সরিয়ে দেয়।
সংস্কারের মূল ক্ষেত্রগুলো হলো—সংসদে উচ্চকক্ষ প্রবর্তন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নিয়োগ প্রক্রিয়া, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রের নীতিমালা সংস্কার, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে অধিষ্ঠান নিষেধ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা ১০ বছর, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া, পিএসসি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার নিয়োগ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের ক্ষমতা, জরুরি অবস্থা জারি, নির্বাচন কমিশন গঠন, স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান নির্ধারণ এবং নারীদের সংসদীয় প্রতিনিধিত্ব।
কিছু সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারলেও বেশিরভাগই সংসদের অনুমোদন বা গণভোটের প্রয়োজন হবে।
ড. আলী রিয়াজ জানান, সংশোধিত খসড়া শিগগির রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করা হবে এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও প্রস্তাব করা হবে। এরপর জাতীয় চার্টার সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশনের সদস্যদের স্বাক্ষরে চূড়ান্ত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “এই সংস্কারগুলো দেশের শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে কিছু ভিন্নমত থেকে যাবে, যার সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার উপর নির্ভর করবে।”