গাজা উপত্যকায় প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর নতুন মাত্রা নিচ্ছে। গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ১১৮ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ জন ছিলেন খাদ্য সহায়তা পাওয়ার লাইনে দাঁড়ানো সাধারণ মানুষ।
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বুলেটিনের শিরোনাম ছিল: “গাজা: অনাহার না গুলিবর্ষণ – এটি কোনও মানবিক সাড়া নয়।” সেখানে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্তত ৫০০ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৪ হাজার আহত হয়েছেন।
এমন এক বিভীষিকাময় বাস্তবতায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা কিছুটা আশার আলো জাগাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ জুলাই ঘোষণা করেন, ইসরায়েল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে নিয়েছে এবং হামাস বর্তমানে সেটি পর্যালোচনা করছে।
ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যম TruthSocial-এ লেখেন, “আমি আশা করি হামাস এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে, কারণ এটি এর থেকে ভালো আর হবে না – বরং আরো খারাপ হবে।”
তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, “পরবর্তী গাজায় কোনও হামাস থাকবে না।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বক্তব্য যুদ্ধবিরতির স্থায়ীত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরি করছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জুলি এম নরম্যান মনে করেন, আগের যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল বিশ্বাসের অভাবে। মে মাসের আলোচনাও কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। হামাস চায় ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারসহ স্থায়ী শান্তিচুক্তি। অন্যদিকে, ইসরায়েল হামাসকে পুরোপুরি গাজা থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়।
নেতানিয়াহু আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন, ছয় মাসে এটি তার তৃতীয় সফর। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চাপ সৃষ্টি করতে পারেন আলোচনার পথে ফিরে যেতে।
যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হয়ে উঠেছে খাবার বিতরণকেন্দ্রে নিহতের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা Gaza Humanitarian Foundation (GHF) নতুন বিতরণব্যবস্থা চালু করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। আগের ৪০০টির বেশি পয়েন্টের পরিবর্তে বর্তমানে মাত্র চারটি বিতরণকেন্দ্র চালু আছে, যা দক্ষিণ গাজায় কেন্দ্রীভূত।
লন্ডনের সিটি সেন্ট জর্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিওনি ফ্লেইশম্যান জানান, নতুন ব্যবস্থাটি সহিংসতা উস্কে দিচ্ছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ অরাজক পরিবেশে খাবারের জন্য সংগ্রাম করছে, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন।
তিনি বলেন, “এটি কার্যত একটি জবরদস্তিমূলক স্থানান্তর পরিকল্পনার অংশ, যার মাধ্যমে উত্তর গাজা থেকে মানুষদের সরিয়ে দক্ষিণে একটি তথাকথিত ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এ পাঠানো হচ্ছে।”
এদিকে, ইরান-ইসরায়েল ১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা কমেনি। বিশ্লেষক বামো নুরি বলেন, যুদ্ধটি কৌশলগতভাবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভুল ছিল। কারণ, এর ফলে ইরান আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার (IAEA) সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয় এবং পারমাণবিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞাহীনভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়।
ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ইরানের ১,০০০ এর বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
অন্যদিকে, ইরান তার সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে। যুদ্ধের পর সেখানে জাতীয়তাবাদী আবেগ বেড়েছে।
নুরি বলেন, “ইসরায়েল সামরিকভাবে শক্তিশালী থাকলেও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়েছে। আর ইরান, ক্ষয়ক্ষতি স্বত্বেও, একতাবদ্ধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে আরও স্বাধীন অবস্থানে এসেছে।”
এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ও প্রকাশ্য গোয়েন্দা বিশ্লেষণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইউএস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে যে তথ্য দেন, সেটি অনেক সময় বাস্তব গোয়েন্দা রিপোর্টের সঙ্গে মেলে না। হালের পরমাণু হামলা সফল হয়েছে কিনা, তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যেও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সারা পোলাক বলেন, ট্রাম্পের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার আমেরিকার রাজনীতির ধরণই বদলে দিয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা ও কূটনৈতিক বার্তাবিনিময়ের ধারা আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে বর্তমানে আলোচনাধীন ট্রাম্পের নতুন ট্যাক্স বিল – ‘One Big Beautiful Bill Act’ – তার এই রাজনৈতিক কৌশলের আরেকটি দৃষ্টান্ত। বিলটির দৈর্ঘ্য ৯৪০ পৃষ্ঠা হলেও এর ‘সৌন্দর্য’ নিয়ে বিতর্ক চলছে, বিশেষ করে যখন প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স নিজের ভোট দিয়ে এটি সিনেটে পাস করাতে সাহায্য করেন।
বিশ্লেষক ডাফিড টাউনলি মনে করেন, এই বিল ও যুদ্ধবিরতি আলোচনা – উভয় ক্ষেত্রেই ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য আগামী দিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হতে চলেছে।