Wednesday, July 2, 2025
Homeবিনোদনবাংলাদেশি সিনেমায় নারীর চিত্র: দর্শনের ভিন্নতা না পুরনো দৃষ্টিভঙ্গির পুনরাবৃত্তি?

বাংলাদেশি সিনেমায় নারীর চিত্র: দর্শনের ভিন্নতা না পুরনো দৃষ্টিভঙ্গির পুনরাবৃত্তি?

সাম্প্রতিক হিট চলচ্চিত্রে নারীর উপস্থাপন প্রশ্ন তুলছে ‘পুরুষ দৃষ্টি’ নিয়ে

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্পে এক ধরনের নবজাগরণ ঘটেছে। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ গল্প, আকর্ষণীয় চিত্রনাট্য আর চমৎকার নির্মাণে ‘তাণ্ডব’, ‘পরাণ’, ‘টুফান’, ‘সুরঙ্গ’ ও ‘দাগী’সহ একাধিক চলচ্চিত্র দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছে।

তবে এই চমকপ্রদ সাফল্যের মধ্যেও রয়েছে একটি গুরুতর প্রশ্ন—এই সিনেমাগুলোতে নারীদের কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে?

চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা বলছেন, এধরনের গল্পগুলোতে নারীরা এখনও মূলত প্রেমিকা, প্রতারক বা শাস্তিপ্রাপ্ত চরিত্রে সীমাবদ্ধ। চরিত্রের গভীরতা নেই, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। বরং তারা পুরুষদের আবেগের অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এটি ব্রিটিশ নারীবাদী চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক লরা মুলভের “Male Gaze” তত্ত্বকে প্রতিফলিত করে—যেখানে নারী চরিত্রকে আত্মনিয়ন্ত্রিত সত্তা নয়, বরং পুরুষের কামনা, বিচার বা প্রতিশোধের বস্তু হিসেবে দেখানো হয়।

‘পরাণ’-এ অনন্যার চরিত্রকে অসংবেদনশীল ও বিভ্রান্তিকর দেখানো হয়েছে। ‘সুরঙ্গ’-এ নারী শুধু একজন বিশ্বাসঘাতক, যিনি পুরুষ চরিত্রের রূপান্তরের কারণ মাত্র। ‘দাগী’-তে ধর্ষণচেষ্টা একটি নৈতিক প্রশ্ন নয়, বরং পুরুষ চরিত্রের ভুল হিসেবে সহজভাবে পাশ কাটানো হয়েছে।

‘হাওয়া’-তে নারীর চরিত্র একমাত্র রহস্যময়ী ও যৌনতা-ভিত্তিক প্রতীক, যার কথা নেই, শক্তি নেই, কেবল পুরুষের ভয় বা কামনার প্রতিফলন।

এই চলচ্চিত্রগুলো শুধু নারীর অভাবনীয় অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করছে না, বরং সামাজিক অসমতা, নিপীড়ন ও নীরবতার সংস্কৃতিকে আবারও প্রতিষ্ঠিত করছে।

আরও চিন্তার বিষয় হলো—এই নারীচিত্র সমাজে কীভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।

‘পরাণ’, ‘সুরঙ্গ’ কিংবা ‘দাগী’-এর মুক্তির পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে একধরনের নারীবিদ্বেষ। অনন্যা চরিত্রকে “ধোঁকাবাজ” বলে সমালোচনা করা হয়েছে, ধর্ষণচেষ্টাকারীর পক্ষ নেওয়া হয়েছে—যেখানে নারীর কণ্ঠ একবারও গুরুত্ব পায়নি।

এই পরিস্থিতিকে “Backlash” বলেছেন নারীবাদী গবেষক সুসান ফেলুদি—যেখানে নারীরা সমাজের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলে তাদের সামাজিকভাবে শাস্তি দেওয়া হয়।

যখন চলচ্চিত্রে নারীর স্বাধীনতা দমন করা হয়, পুরুষের সহিংসতাকে মহিমা দেওয়া হয়, তখন তা শুধু ফিকশন থাকে না—তা হয়ে ওঠে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির আয়না।

তবে সব সিনেমা একই রকম নয়। ‘নো ডরাই’, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, ও ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলো দেখিয়েছে যে নারীকেন্দ্রিক, গভীর ও সাহসী গল্প বলাও সম্ভব।

চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যেখানে তারা কেবল বিনোদনই নয়, সমাজ বদলাতেও ভূমিকা রাখতে পারেন।

কারণ পর্দায় যা দেখা যায়, তা শুধু গল্প নয়—তা হয়ে ওঠে সমাজের মানসচিত্র।
আর যখন নারীরা দেখা যায়, কিন্তু শোনা যায় না, তখন গল্পটা শুধু অসম্পূর্ণ নয়—তা হয়ে যায় বিকৃত।

RELATED NEWS

Latest News