ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১২ দিনের ভ্রমণ সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে।
প্রতিষ্ঠানটি দেশের নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন পোর্টাল, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং নিজস্ব সূত্রের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে মোট ৩৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৩১২ জন, আহত হয়েছেন ১ হাজার ৫৭ জন।
প্রতিদিন গড়ে ২৬ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৯ দশমিক ০৩ শতাংশ বেশি।
দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দুর্ঘটনার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালনা এবং দুর্বল সড়ক ব্যবস্থাপনা। ঈদের ভ্রমণে ব্যাপক চাপ ও সুরক্ষিত যানবাহনের অভাব দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
জুনের ৩ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত ১২ দিনের তথ্যে দেখা যায়, নিহতদের মধ্যে ৪৭ জন নারী এবং ৬৩ জন শিশু।
প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, দুর্ঘটনার কারণে মানবসম্পদের আর্থিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকায়।
কোন এলাকায় কত দুর্ঘটনা?
ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১১৬টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৭ জন। শুধু ঢাকা শহরেই ঘটেছে ৩৮টি দুর্ঘটনা, যাতে মারা গেছেন ৬ জন এবং আহত হয়েছেন ৫৩ জন।
সর্বনিম্ন দুর্ঘটনা ঘটেছে সিলেট বিভাগে, ১৩টি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ জন।
জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ফরিদপুরে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে—২৭টি ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৯ জনের। চাঁপাইনবাবগঞ্জে কিছু দুর্ঘটনা হলেও কেউ মারা যাননি।
যানবাহনভিত্তিক বিশ্লেষণ: মোটরসাইকেলেই বেশি মৃত্যু
মোট ৫৮৯টি যানবাহনের মধ্যে ১২৮টি দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল মোটরসাইকেল। এতে ১০৭ জন মোটরসাইকেল আরোহী ও যাত্রী নিহত হন।
এই ধরনের দুর্ঘটনায় ৫৪ দশমিক ২০ শতাংশই ছিল ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী।
অন্যান্য যানবাহনের পরিসংখ্যান:
১১৪টি বাস দুর্ঘটনায় নিহত ৩৩
৮৯টি ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান/পিকআপে নিহত ১৮
৪৯টি প্রাইভেট কার/অ্যাম্বুলেন্সে নিহত ১১
১২৬টি থ্রি-হুইলারে নিহত ৭৩
৪১টি স্থানীয় যানবাহনে (নসিমন, মাহিন্দ্রা) নিহত ২০
১৩টি বাইসাইকেল/রিকশায় নিহত ৬
এছাড়া ৯টি নৌপথ দুর্ঘটনায় ১০ জন মারা গেছেন, ৩২টি রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২১ জন।
কোন সড়কে বেশি দুর্ঘটনা?
জাতীয় মহাসড়কেই ঘটেছে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা—১৩৬টি, যা মোটের ৩৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।
এর বাইরে ১২১টি আঞ্চলিক সড়ক, ৩৪টি গ্রামীণ সড়ক এবং ৫৬টি শহরের সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে।
কারণ বিশ্লেষণ
গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে ঘটেছে ১৬৩টি দুর্ঘটনা। মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ৮১টি, পথচারী চাপা পড়ে ৪৬টি, পেছন দিক থেকে সংঘর্ষ ৫১টি এবং অন্যান্য কারণে ৬টি দুর্ঘটনা ঘটে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, “ঈদের ৪-৫ দিনের যাতায়াতে পর্যাপ্ত নিরাপদ গণপরিবহন না থাকায় মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়। এর ফলেই বাড়ছে দুর্ঘটনা।”
তিনি বলেন, নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিতে তিন বছর মেয়াদি একটি টেকসই পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। রেলওয়ে, নৌপথ ও সড়ক–সবখানে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।
রেললাইন উন্নয়ন, রুট সম্প্রসারণ, বিআরটিসি বাস বাড়ানো ও অনিরাপদ যানবাহন অপসারণের ওপর জোর দেন তিনি।
চালকদের বেতন, সময় ও কাজের শর্ত নির্ধারণ এবং সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের কথাও বলেন তিনি।
সবচেয়ে জরুরি, ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে কোনো প্রকার বাধা থাকা উচিত নয়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি ঈদের ছুটি দীর্ঘ করতে হবে।
তিনি যোগ করেন, “জনপরিবহনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, ছোট যানবাহন বন্ধ করতে হবে, দক্ষ চালক নিশ্চিত করতে হবে এবং সড়কের মানোন্নয়ন ও আইন বাস্তবায়ন জোরদার করতে হবে।”
এই ঈদে সড়কে প্রাণহানি ও ভোগান্তি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে—নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিতে সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের আর বিকল্প নেই।