যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বিশ্বের শীর্ষ ধনী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এলন মাস্কের মধ্যকার সম্পর্ক এখন স্পষ্টতই চরম বিপর্যয়ের মুখে। একসময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র, এখন যেন প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। বৃহস্পতিবার দিনজুড়ে সামাজিক মাধ্যমে চলে তীব্র বাকবিতণ্ডা।
সবকিছু শুরু হয় হোয়াইট হাউসে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জের সঙ্গে বৈঠকের সময় ট্রাম্পের এক মন্তব্য দিয়ে। তিনি বলেন, মাস্কের ওপর তিনি “ভীষণ হতাশ”। এর আগে মাস্ক সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্পের ব্যয়বহুল বিলের সমালোচনা করেছিলেন, যেটিকে তিনি “ঘৃণিত কাণ্ড” বলে অভিহিত করেন।
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পরপরই মাস্ক জবাব দেন তার নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ। তিনি ট্রাম্পকে হুমকি দেন সরকারি চুক্তি বাতিল নিয়ে এবং অভিযোগ তোলেন যে এপস্টেইন সংক্রান্ত সকল নথি প্রকাশিত হয়নি, কারণ তাতে ট্রাম্পের নাম রয়েছে।
ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল-এ লেখেন, “আমাদের বাজেট বাঁচানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এলনের সরকারিভিত্তিক চুক্তি ও ভর্তুকি বাতিল করা।”
এর জবাবে মাস্ক লিখেন, “এসো, আমার দিনটা আনন্দময় করো।” পরে তিনি ঘোষণা দেন, নাসার সঙ্গে স্পেসএক্সের যে মহাকাশযানগুলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যান নিয়ে যেত, সেগুলো ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হবে।
তবে সবথেকে বিতর্কিত মন্তব্য ছিল মাস্কের এপস্টেইন ফাইল সংক্রান্ত অভিযোগ। তিনি বলেন, “ট্রাম্প এই ফাইলে আছেন। এজন্যই এগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে না।” এই মন্তব্য কোনো প্রমাণ ছাড়াই তিনি দেন, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এ সংঘাতের ফলে মাস্ক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। টেসলার শেয়ার মূল্য একদিনে ১৪ শতাংশ পড়ে যায়, যার ফলে কোম্পানির বাজারমূল্য থেকে কমে যায় প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। মাস্ক ব্যক্তিগতভাবে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হন।
রাজনীতিতে ডোনারদের সঙ্গে নেতাদের সম্পর্ক টেকসই না হলেও, মাস্কের মতো একজন প্রভাবশালী প্রযুক্তিবিদের সঙ্গে ট্রাম্পের এতটা দ্রুত সম্পর্কের অবনতি নজিরবিহীন। মাস্ক কমপক্ষে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছিলেন, যা নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
মাস্কের দাবি, “আমার ছাড়া ট্রাম্প নির্বাচনে জিততেন না।” পরে আবার যোগ করেন, “এমন অকৃতজ্ঞতা।”
মজার বিষয়, সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল গত বছরের জুলাইয়ে, যখন ট্রাম্প পেনসিলভানিয়ায় এক সমাবেশে হামলার শিকার হন। মাস্ক তখন প্রকাশ্যে তার পক্ষে দাঁড়ান এবং পরে বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
তিন মাস আগে ট্রাম্প মাস্কের কাছ থেকে একটি লাল রঙের টেসলা কিনে তার ব্যবসার প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানান। এরপর হঠাৎই এই সম্পর্কের ভাঙন শুরু হয়।
মাস্ক সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে বিলটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তার মতে, বিলটি না দেখিয়েই কংগ্রেসে পাশ করা হয়েছে এবং এটি বৈদ্যুতিক গাড়ির ট্যাক্স ক্রেডিট বাতিল করছে, যা মাস্কের ব্যবসার জন্য নেতিবাচক।
এদিকে ট্রাম্প দাবি করেন, মাস্ক জ্যারেড আইজ্যাকম্যানকে নাসার নেতৃত্বে বসানোর জন্য চাপে রেখেছিলেন। যদিও ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন এবং তাকে “পুরোপুরি একজন ডেমোক্র্যাট” বলে অভিহিত করেন।
মাস্ক সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্পের পুরনো পোস্ট তুলে ধরেন, যেখানে তিনি নিজেই ব্যয়ের সমালোচনা করেছিলেন। জবাবে মাস্ক প্রশ্ন করেন, “যে ব্যক্তি এই কথা লিখেছিল, সে কি এখন আর সেই ব্যক্তি নেই?”
সবশেষে, হোয়াইট হাউসের বাইরে ট্রাম্পের লাল টেসলা গাড়িটি তখনো পার্ক করা ছিল, যেন স্মারক হয়ে আছে এক সম্পর্কের উত্থান ও পতনের চিহ্ন।
এই ঘটনায় রাজনৈতিক মহলসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোড়ন তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতের মার্কিন নির্বাচনী রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।