Tuesday, November 11, 2025
Homeজাতীয়ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন: ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব চরের মানুষ, নেপথ্যে জলবায়ু পরিবর্তন

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন: ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব চরের মানুষ, নেপথ্যে জলবায়ু পরিবর্তন

এক বছরে দুবার ঘর বদল, হিমালয়ের বরফ গলার প্রভাবে তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন, বাড়ছে দুর্ভোগ

মেঘলা সকালে বাঁশের খুঁটি আর টিনের চালা নৌকায় তুলছিলেন নূরুন নবী। এক বছর আগেই ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা এক ভঙ্গুর চরে ঘর তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ঘর এখন নদীর গ্রাসে বিলীন হওয়ার পথে।

এক বছরের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ঘর সরাতে হচ্ছে চার সন্তানের জনক এই কৃষককে। ক্লান্ত স্বরে তিনি বলেন, “নদী প্রতিদিন কাছে চলে আসছে। আমাদের জন্মই যেন দুর্ভোগের জন্য। এই সংগ্রামের কোনো শেষ নেই। কতবার যে নদী আমার ঘর কেড়ে নিয়েছে, তার হিসাব হারিয়ে ফেলেছি।”

৫০ বছর বয়সী নূরুন নবীর এখন আরেকটি চরে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তার ধান ও মসুর ডালের খেত আগেই ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে। এই নদ হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে চীন ও ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

বিশাল বাদামী নদীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “নতুন ঠিকানায় আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে জানি না। কপাল ভালো হলে হয়তো কয়েক বছর থাকতে পারব, না হলে হয়তো এক মাস। এটাই আমাদের জীবন।”

রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে যায় ভূমি

প্রতি বছর উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম জেলার শত শত পরিবার একই পরিণতির মুখোমুখি হয়। নদীভাঙনে মানুষ শুধু তাদের বাড়িই হারায় না, হারায় তাদের জমি, ফসল এবং গবাদিপশু। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলার মতো নদীগুলো, যা একসময় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনরেখা ছিল, এখন আরও বেশি অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে এবং আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে জমি গ্রাস করছে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বালুকাময়, ক্ষণস্থায়ী চরগুলো দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানকার পরিবারগুলো বারবার ঘর তৈরি করে, আর নদী এসে তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায়।

৭০ বছর বয়সী কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, “পানি কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই আসে। রাতে ঘুমাতে যান, আর ভোরের মধ্যেই নদীর পাড় সরে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখেন আপনি গৃহহীন। আমাদের জীবনে কোনো শান্তি নেই।”

আগামী ১০ থেকে ২১ নভেম্বর ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ৩০) দিকে যখন বিশ্ববাসীর চোখ, তখন বাংলাদেশের এই সংগ্রাম বিশ্বনেতাদের জন্য এক কঠোর বার্তা দিচ্ছে। বাঁধ নির্মাণ, বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নতি এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক অভিযোজনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশকে প্রায়শই দুর্যোগ সহনশীলতার মডেল হিসেবে প্রশংসা করা হয়। কিন্তু শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং জলবায়ু অর্থায়ন ছাড়া এই প্রচেষ্টাগুলো যথেষ্ট হবে না।

পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, “এখানকার মানুষ এমন দূষণের মূল্য দিচ্ছে যা তারা কখনও করেনি। কপ৩০-এর যদি কোনো অর্থ থাকে, তবে তাকে অবশ্যই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ বা ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বাস্তবসম্মত তহবিল সরবরাহ করতে হবে এবং আমাদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে জীবন ও ভূমি রক্ষায় সাহায্য করতে হবে।”

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কুড়িগ্রামে যা ঘটছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের এক দৃশ্যমান রূপ। ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার উৎস হিমালয়ের হিমবাহগুলো এখন দ্রুতগতিতে গলছে।

ড. আইনুন নিশাত বলেন, “আমরা দ্রুত হিমবাহ গলতে দেখছি, যা ১৯৯০-এর দশকের হারের প্রায় দ্বিগুণ। অতিরিক্ত পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, যা আগে থেকেই স্ফীত নদীগুলোতে আরও চাপ সৃষ্টি করছে।”

একই সময়ে, বর্ষা আরও অনিয়মিত হয়ে উঠেছে। এটি আগে আসছে, দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এবং তীব্র ও আকস্মিক ধারায় ঝরছে। আইনুন নিশাত বলেন, “ঋতুর ছন্দ বদলে গেছে। যখন বৃষ্টি হয়, তখন খুব বেশি হয়, আবার যখন থামে, তখন প্রায়ই খরা দেখা দেয়। এই অস্থিতিশীলতা ভাঙন এবং বন্যাকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে।”

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের কারণে প্রতি সাতজন বাংলাদেশির মধ্যে একজন বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

৫০ বছর বয়সী সাত সন্তানের জনক কছিম উদ্দিনের জন্য ঘর বদলানো এখন এক রুটিনে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, “আমার জীবনে নদী ৩০ বা ৩৫ বারেরও বেশি আমার বাড়ি কেড়ে নিয়েছে।”

টিকে থাকার লড়াই

খেয়ার আলগা চরে, স্থানীয় সংস্থাগুলো জিওব্যাগ (বালিভর্তি বড় বস্তা) স্থাপন করার পর প্রায় ৩০০ পরিবার গত তিন বছর ধরে টিকে থাকতে পেরেছে। এই জিওব্যাগ নদীর পাড়কে ভাঙনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে।

৩৯ বছর বয়সী জহুরুল ইসলাম বলেন, “জিওব্যাগ একটি বিশাল পরিবর্তন এনেছে। গত তিন বছরে নদী আমাদের জমি নেয়নি। প্রথমবারের মতো আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী বোধ করছি।”

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে জহুরুল ইসলাম এক ধরনের সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মৃদু হেসে তিনি বলেন, “হয়তো নদী একদিন আবার আসবে। কিন্তু এবার আমরা প্রস্তুত থাকব। আপাতত, মাটি ধরে রেখেছে এবং আমরাও টিকে আছি।”

RELATED NEWS

Latest News