সূক্ষ্ম টেক্সচার এবং আবছা আকৃতি দিয়ে সাজানো এক উজ্জ্বল সোনালি ক্যানভাস। ভারতের কিংবদন্তী শিল্পী বাসুদেব এস গাইতোন্ডের ১৯৭১ সালের নামহীন এই চিত্রকর্মটি সম্প্রতি দিল্লির স্যাফ্রনআর্ট নিলামে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নিলামে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকর্ম বিক্রির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪০.২ মিলিয়ন ডলারের রেকর্ড হয়, যার মধ্যে গাইতোন্ডের ছবিটিই বিক্রি হয় ৭.৫৭ মিলিয়ন ডলারে, যা তার আনুমানিক মূল্যের প্রায় তিনগুণ। এই বিক্রির মাধ্যমে ছবিটি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামী চিত্রকর্মে পরিণত হয়েছে।
এই নিলামটি ভারতের শিল্পকলার বাজারে চলমান তেজিভাবকে আরও গতি দিয়েছে। এর মাত্র কয়েকদিন পরেই, সোদবি’র নিলামে শিল্পী ফ্রান্সিস নিউটন সুজার আঁকা ‘হাউসেস ইন হ্যাম্পস্টেড’ ছবিটি গাইতোন্ডের ছবির চেয়ে সামান্য কম দামে বিক্রি হয়ে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ দামী ছবির স্থান দখল করে। চলতি বছরের শুরুতে এম. এফ. হুসেনের ‘আনটাইটেলড (গ্রাম যাত্রা)’ ১৩.৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়ে ভারতের সবচেয়ে দামী চিত্রকর্মের রেকর্ড গড়েছিল।
নিলামকারী এবং কিউরেটররা বলছেন, ভারতের শিল্পকলার বাজার এক অভূতপূর্ব উত্থানের সাক্ষী হচ্ছে। দেশজুড়ে বিভিন্ন শহর ও নগরে আর্ট ফেয়ার, গ্যালারি এবং প্রদর্শনী স্থানের সংখ্যা বৃদ্ধি এই বাজারকে এগিয়ে নিচ্ছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে এই বাজারের মূল্য প্রায় ৩৩৮ মিলিয়ন ডলার, যা এই শতাব্দীর শুরুতে মাত্র ২ মিলিয়ন ডলার ছিল। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাজার ১.১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। স্যাফ্রনআর্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দীনেশ ভাজিরানি এটিকে একটি “গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ” বলে মনে করেন।
বৈশ্বিক শিল্পকলার বাজার যখন মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখনও ভারতের বাজার এগিয়ে চলেছে। ২০২৪ সালের আর্ট বাসেল এবং ইউবিএস রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিল্পকর্ম বিক্রি ১২% কমেছে। দীনেশ ভাজিরানি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, ভারতে এবং প্রবাসীদের মধ্যে সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ায় নিলাম বাজার গত বছরের আয়কে দ্বিগুণ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে কোটিপতি পরিবারের সংখ্যা গত চার বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ধনীরা তাদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অর্থ বিনিয়োগ করার ফলে শিল্পকর্ম এখন আভিজাত্যের প্রতীক এবং একটি ভালো বিনিয়োগ উভয়ই হয়ে উঠেছে।
এই উত্থানের পেছনে প্রবাসী ভারতীয় সংগ্রাহকদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সোদবি’র ভারতীয় ও দক্ষিণ এশীয় শিল্প বিভাগের সহ-প্রধান মঞ্জরী সিহারে-সুতিন বলেন, প্রবাসী সংগ্রাহকরা তাদের “ঐতিহ্যের একটি অংশ” খুঁজছেন। শিল্পকর্ম তাদের শিকড়ের সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এই প্রবণতাগুলো নতুন ক্রেতাদেরও আকৃষ্ট করছে। সোদবি’র গত মাসের নিলামে এক-তৃতীয়াংশ দরদাতা ছিলেন নতুন, অন্যদিকে স্যাফ্রনআর্ট জানিয়েছে তাদের ২৫-৩০% ক্রেতাই সম্প্রতি বাজারে প্রবেশ করেছেন।
এই উত্থান শুধুমাত্র নিলাম এবং গ্যালারির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কিউরেটর ইনা পুরি বলেন, ভারতীয় শিল্পীদের ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি এবং জনসাধারণের জন্য নতুন স্থান তৈরিতে বিনিয়োগ ভারতের শিল্প জগতে একটি পুনর্জাগরণ এনেছে। তিনি বলেন, “আমার মনে হচ্ছে ভারতীয় শিল্পকলা আবার ফিরে এসেছে।”
কর্ণাটকের হাম্পি আর্ট ল্যাবস এবং নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য আর্ট মুম্বাই ফেয়ারের মতো আয়োজনগুলো এই খাতের বিস্তৃতি প্রমাণ করে। তবে এই তেজি বাজারের মধ্যেও উদীয়মান এবং প্রান্তিক শিল্পীদের জন্য আরও সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। দিল্লির অলাভজনক সংস্থা ‘খোজ’-এর পরিচালক পূজা সুদ বলেন, রেকর্ড ভাঙা বিক্রি সরাসরি নতুনদের সাহায্য করে না। তরুণ শিল্পীদের পরীক্ষামূলক কাজের জন্য জায়গা তৈরি করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।