মায়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আং সান সুচির ছোট ছেলে কিম অ্যারিস চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে তাঁর মায়ের মুক্তির জন্য পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
৪৮ বছর বয়সী অ্যারিস দীর্ঘদিন জনসম্মুখে কথা বলেননি। কিন্তু ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর, যখন তাঁর মা কারাগারে বন্দি হন, তখন তিনি লন্ডন থেকে প্রকাশ্যে এসে মায়ের শারীরিক অবস্থা ও কারাবাসের কঠোর পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সুচি বর্তমানে ৮০ বছর বয়সী এবং জীবনের ১৯ বছর কারাবন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন। কখনো গৃহবন্দি, কখনো একাকী কারাগারে।
অ্যারিস বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে আহ্বান জানাচ্ছি যেন তিনি মায়ের মুক্তির জন্য মিয়ানমারের সেনা সরকারের ওপর চাপ বাড়ান। চীনই এখন সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী দেশ, যাদের পদক্ষেপই পরিবর্তন আনতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার জানা মতে, চীন সুচির মুক্তি চেয়েছে। তারাও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায়, কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকেই দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।”
অ্যারিস উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, “আমি প্রতিদিন ভাবি, আমার মা হয়তো কারাগারে মারা যেতে পারেন। সেখানে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ।”
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের কারাগারে বন্দিদের ওপর নির্যাতন চলছে, যার মধ্যে রয়েছে মারধর, বৈদ্যুতিক শক, যৌন সহিংসতা ও অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন।
মিয়ানমারের ছায়া সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) সতর্ক করে বলেছে, সুচি যদি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন বা মুক্তি না পান, তবে দেশের রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে।
এনইউজি–এর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মন্ত্রী সাসা বলেন, “তাঁর অনুপস্থিতি জাতীয় বিভাজনকে আরও তীব্র করবে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্থিরতা বাড়াবে।”
অ্যারিস বলেন, তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে আবার দেখা করতে চান। ১৯৮৮ সালে সুচি ইয়াঙ্গুনে গিয়ে মায়ের সেবায় যুক্ত হওয়ার পর থেকেই তারা বিচ্ছিন্ন। সেই সময় থেকেই সুচি সামরিক সরকারের বিরোধিতার কারণে গৃহবন্দি হন।
তিনি মনে করেন, সুচির সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। “আমার মা চীনের সঙ্গে একটি কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, যা তাঁর দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল,” বলেন অ্যারিস।
২০২০ সালে সুচি ও শি জিনপিং সাক্ষাৎ করেন, যেখানে চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডরসহ ৩৩টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই বছরই মিয়ানমার চীন-সমর্থিত আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি ‘রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’-এ যোগ দেয়।
চীন বর্তমানে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশটিতে চীনের বিনিয়োগ ৭.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
অ্যারিস বলেন, সামরিক সরকারের কারণে মিয়ানমারে বেআইনি কার্যক্রম বেড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রতারণা কেন্দ্র ও মানবপাচার। এসব কর্মকাণ্ডে হাজারো চীনা নাগরিকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ এসব প্রতারণা কেন্দ্রে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি বলেন, “চীন নিজেও স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি চায়। কিন্তু এই ভুয়া নির্বাচন শান্তি আনবে না, বরং আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।”
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং সেনা সরকার দেশের অর্ধেকেরও কম অংশে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।
ডিসেম্বরে নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনকে অনেক বিশ্লেষক ‘প্রহসন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইতিমধ্যে সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিসহ ৪০টির বেশি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক কারণে ২৯ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২২ হাজারের বেশি এখনো কারাগারে।
অ্যারিসের মতে, সুচির মুক্তিই মিয়ানমারের সংকট নিরসনের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। “আমার মায়ের মুক্তি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব,” বলেন তিনি।